শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সব শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলাম নিয়ে বেজায় খুশি, শিক্ষকদেরও একটি বড় অংশ খুশি। শুধু রাজনৈতিক কারণে একটি মহল, ধর্মীয় কারণে, নোট-গাইডের ব্যবসায়ীরা এর বিরোধিতা করছে। আমার ২০০ বছর ধরে প্রশ্নোত্তর আকারে পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, সেটি ছিল মুখস্থনির্ভর যা বেশিদিন মনে থাকে না। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল ও আনন্দের মাধ্যমে শিখবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বলেছেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে আমি কিছুট অস্বস্তি লক্ষ্য করেছি। আগামী দিনের উপযুক্ত নাগরিক করে গড়ে তোলার জন্যই এ কারিকুলাম। মানুষ সব সময় যে অবস্থায় থাকে, সে অবস্থাই পছন্দ করে। নতুন পদ্ধতি কেমন হবে এ নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে। পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের দিকে যাচ্ছি। যেকোনো পরিবর্তন সফল করা চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর বৃহত্তম ব্যবস্থাগুলোর একটি। কারণ ভারতে শিক্ষাটা রাজ্যের ব্যাপার। বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি একটি কেন্দ্রীভূত শিক্ষাব্যবস্থা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং।’ মন্ত্রী ও সচিবের কথাগুলো আমরা সবাই বিশ্বাস করি, তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করছি। দ্বিমত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সমস্যাটা হচ্ছে বাস্তবায়ন নিয়ে, ধোঁয়াশা পরিবেশ নিয়ে।
আদর্শ ট্রাফিক নিয়ম অনুযায়ী একটি শহরের নাকি ২৫ শতাংশ থাকতে হয় রাস্তাঘাট, সেখানে ঢাকা সিটিতে আছে ৬ থেকে ৭ ভাগ। অতএব, ট্রাফিক জ্যাম তো হবেই। তারপরেও সাধারণ সময়ে দেখা যায় একটি গাড়ি আর একটি গাড়ির আগে যাবে কিংবা যাত্রী তোলা নিয়ে কথা কাটাকাটি করে, যত্রতত্র যাত্রী উঠায়। পেছনের গাড়িঘোড়ার দিকে খেয়াল করে না। ফলে তিন-চার মিনিটের মধ্যেই শত শত যানবাহনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ ছাড়াও রয়েছে ট্রাফিক পুলিশদের গাড়ি চেক তাও এই অ্যাবনরমাল অবস্থার মধ্যে। এসব কারণে চার-পাঁচ মিনিটের একটু বেশি হলেই জ্যাম সবার নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে যায়।
তখন সবাই হাল ছেড়ে দেয়। এ ঘটনা আমরা প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা সিটির কোথাও না কোথাও প্রত্যক্ষ করি। আমাদের নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবই সংশোধনের ক্ষেত্রেও সেই ধরনের একটি অবস্থা বিরাজ করছে। নানামুখী চাপে গত জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের অসঙ্গতি, ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে সুপারিশ দেয়ার জন্য গত ৩১ জানুয়ারি ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। পরবর্তী সময়ে ১ মাসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। ১ মাস পুরো হওয়ার ৫ দিন আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি ওই কমিটিই পাল্টে দিয়ে নতুন আরেকটি ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় মন্ত্রণালয়। এখনও সংশোধনী কি হবে তা ঠিক করা যায়নি। এর ফলে সহসা পাঠ্যবইয়ের চূড়ান্ত গতি প্রকৃতি যেমন জানা যাচ্ছে না, তেমনি সংশোধনের নামে বছরের অর্ধেক সময় চলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা কি পড়বে- সে প্রশ্নের জবাব আপাতত মিলছে না। পাশাপাশি পাঠ্যবই সংশোধনীর প্রথম কমিটি কাজের সম্মানী হিসেবে সরকারের কাছে ২৫ লাখ টাকা দাবি করে চিঠি পাঠিয়েছে বলে পত্রিকায় দেখলাম। মূল্যায়ন নিয়ে বিভ্রান্তিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। আর এনসিটিবি ও মাউশি থেকে বারবার বলা হচ্ছে শিক্ষা হবে আনন্দময়। কিন্তু আনন্দের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না বরং বাড়ছে উদ্বিগ্নতা কারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, তার কোনো নির্দেশিকা দেয়া হয়নি। এনসিটিবি মে মাসে নির্দেশিকা প্রকাশ করার কথা বলছে। তবে, সেখানে ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন কীভাবে হবে সেটি থাকবে। আমরা এরই মধ্যে জেনেছি যে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে এবং আগামী বছর অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ও সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ের ৬০ শতাংশ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন আর ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। আর বাকি বিষয়গুলো জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতকরা ১০০ ভাগ। কিন্তু কোনো ধরনের মূল্যায়নের কোনো নির্দেশিকা না দেয়ায় সবাই হতাশ এবং দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। ১৩ মার্চ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রচলিত পরীক্ষা না নিতে স্কুলগুলোকে নির্দেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর কারণ কিছু কিছু স্কুল আগের নিয়মানুযায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া শুরু করেছিল। সেখানে বলা হয়, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন-শেখানো ও মূল্যায়ণ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এনসিটিবি প্রণীত শিক্ষক সহায়িকা এবং শিক্ষাক্রমের নির্দেশনা অনুসারে করতে হবে। অথচ কোনো বছরই সব স্কুলে টিজি সময়মতো পৌঁছায় না, কিছু কিছু বিদ্যালয়ে একেবারেই পৌঁছে না। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনো পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট নেয়া যাবে না। মূল্যায়নের গাইডলাইন পরবর্তী সময়ে জানিয়ে দেয়া হবে। রোজার ছুটির মাসখানেক পরেই অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা; কিন্তু এখনও বিষয়টি কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। কি করবেন শিক্ষকরা? অভিভাবকরাও তাই উদ্বিগ্ন।
নির্দেশক অনুযায়ী শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষক নির্ধারিত ঘরে টিকচিহ্ন দেবেন। এই পারদর্শিতা আবার তিনটি স্তরে বিভক্ত: প্রারম্ভিক, মাধ্যমিক স্তর, পারদর্শী স্তর। প্রারম্ভিক স্তরে থাকা কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষা বছরের যে কোনো সময়ে তার দক্ষতার স্তর বাড়ানোর সুযোগ পাবে। শিক্ষার্থীরা স্তর বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক মূল্যায়নের ছকে পরিবর্তন আনবেন। এভাবে বছরজুড়ে ধারাবাহিক বা শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করবে। মূল্যায়নপত্রে বা রেজাল্ট কার্ডে নম্বর না থাকায় প্রথম অভিভাবকরা বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। নম্বর নয় বরং শ্রেণিভিত্তিক নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করানোই মূল্য লক্ষ্য। ধারাবাহিক মূল্যায়নের পাশাপাশি সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর স্তর বা অবস্থান যাচাই করতে হবে। এ যাচাইয়ের কাজে আগের মতো শুধু লিখিত পরীক্ষা হবে না। এখন লেখার পাশাপাশি মূল্যায়নের কাজে যোগ হয়েছে বলার কাজ, বিষয় উপস্থাপনা, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, স্বপরীক্ষণ, আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদি প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীর এককভাবে এবং দলগতভাবে কাজ করে তাদের দক্ষতা প্রকাশ করার সুযোগ পাবে। এগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ; কিন্তু শিক্ষকদের জন্য সঠিক নির্দেশিকা তো থাকতে হবে। এনসিটিবি বলছে মূল্যায়ন নির্দেশিকা প্রস্তত থাকলেও অবৈধ নোট-গাইড প্রকাশ বন্ধ করতে কৌশলগত কারণে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির মূল্যায়ন নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়নি। যদিও নতুন শিক্ষাক্রমের এ দুই শ্রেণির গাইড বই প্রকাশ আটকাতে পারেনি এনসিটিবি। এদিকে শিক্ষক ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে মূল্যায়ন নির্দেশিকা প্রকাশের চাপ আছে। এমন পরিস্থিতিতে হতাশ এনসিটিবি কর্মকর্তারাও। তারা এখন বলছেন, শিগগিরই এ নির্দেশিকা তারা প্রকাশ করবেন।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মেধা বিকাশে এবং চিন্তন দক্ষতা উন্নত করতে চাই, তাহলে তো তাদের সীমিত করে দিলে হবে না। তারা যে কোনো জায়গা থেকেই হোক জ্ঞান আহরণ করবে। তার যা জানার দরকার ছিল, যে দক্ষতা অর্জন করার দরকার ছিল সেটি করেছে কি-না তার জন্য ভালো একটি অ্যাসেসমেন্ট প্রক্রিয়া প্রয়োজন। আর সেটিকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে বলে চলেছি নোট-গাইড বন্ধ করার জন্য এটি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বাস্তবধর্মী জ্ঞান অর্জনের জন্য এ কারিকুলাম করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইইএলটিএস পরীক্ষায় পুরো গাইডলাইন দেয়া থাকে। সে অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে সাহায্যকারী বই, টিচিং ম্যাটেরিয়ালস, কোচিং সবকিছু চলছে। তাই বলে ওই পরীক্ষার মান কি কমেছে? আর আমরা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাইকে অন্ধকারে রেখে শুধু বলে চলেছি শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের জন্য সবকিছু করা হচ্ছে, আর বাজার থেকে নোটগাইড বন্ধ করার জন্য এসব করা হচ্ছে। বিষয়টি খুবই সাংঘর্ষিক। এনসিটিবি থেকে মূল্যায়ন নির্দেশিকা বিলম্বে প্রকাশ করে নোট-গাইড প্রকাশ বন্ধ করা যাবে কি? নোট-গাইড যারা প্রকাশ করে তারা তো বসে থাকবে না। তাদের লাখ লাখ টাকার ব্যবসা। তারা ধারণা থেকে কিংবা অবাস্তব, এলোমেলো অনেক কিছু মিলিয়ে তাদের বই আরও বড় করে শিক্ষার্থীদের কাছে দেয়ার চেষ্টা করবে এবং করছে। শিক্ষার্থীদের মাথা এতে আরও ভারী হয়ে হচ্ছে। আর তারা যখন দেখছে, সরকার থেকে কোনো নির্দেশনা যাচ্ছে না, তখন তারা সুযোগ তো আরও বেশি পেয়ে যায়। আর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও তো চাবেন, শিক্ষার্থীরা কিছু একটা করুক। এনটিবি যেহেতু সবকিছু প্রকাশ করেনি, যারা কিছু করেছে তাদের কাছ থেকে বই তো নেয়াই যায়।
সবশেষে বলা যায়, আমরা এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে শিক্ষাকে কেন কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার মধ্যে ধরে রেখেছি? আমরা কি সঠিক সময়ে সবকিছু সঠিকভাবে করতে পারছি? পারছি না তো। প্রতি বছরই তো এ ধরনের সমস্যা লেগে থাকে। তার চেয়ে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপের মাধ্যমে শিক্ষার এই বিষয়গুলো করার চেষ্টা করছি না কেন?