আপনাদের ভাবনা

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি

আর কে চৌধুরী

প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটের ৫ হাজার দোকান পুড়ে গেছে ৬ ঘণ্টার আগুনে। মঙ্গলবার দিনটি যেন অমঙ্গলের রাহুগ্রাস নিয়ে হাজির হয়েছিল ৫ হাজার দোকান মালিক এবং প্রায় বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর জীবনে। ঈদকে সামনে রেখে প্রতিটি দোকানে ব্যবসায়ীরা উঠিয়েছিলেন বিপুল পরিমাণ পণ্যসামগ্রী। ঈদকে সামনে রেখে তারা দেখছিলেন সমৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন। ব্যবসায়ীদের দাবি, আগুনে ছাই হয়েছে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার সামগ্রী। রক্ষা পায়নি পুলিশ সদর দপ্তরও। মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে শুরু হওয়া আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় তলব করা হয়েছিল সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অগ্নিনির্বাপক ইউনিটকে। ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয় সেনা, নৌ, বিমান, বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাব, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। সবার একাগ্র চেষ্টায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। তবে সন্ধ্যার দিকেও এনেক্সকো ভবনের পাঁচ ও ছয়তলা থেকে থেমে থেমে ধোঁয়া এবং আগুনের ফুলকি বের হচ্ছিল। সান্ত¡না শুধু এটুকু যে, আগুনে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।

১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় বঙ্গবাজার। পরে নতুন করে গড়ে তোলা হয় ওই মার্কেট। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই সেখানে আবার আগুন লাগে। পুড়ে যায় মার্কেটের গুলিস্তান ইউনিটের কয়েকটি দোকান। আগুন নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট কাজ করে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিমত, প্রথমেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে এনেক্সকো টাওয়ারে। পর্যায়ক্রমে তা অন্যান্য মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে চার বছর আগেই বঙ্গবাজার মার্কেটকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। তারা একটি সতর্কতামূলক ব্যানারও লাগিয়ে দিয়েছিল। এ পর্যন্ত ১০ বার সতর্ক করা হলেও তা পাত্তা দেননি বঙ্গবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আমাদের সহানুভূতি। তবে আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের ওপর ব্যবসায়ীদের চড়াও হওয়া শুধু নিন্দনীয় নয়, এটি চরম কাণ্ডজ্ঞানহীনতারই পরিচায়ক।

রাজধানীর কেন্দ্রে স্টকলটের পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত বঙ্গবাজার থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মালপত্র সরবরাহ করা হয়। শুধু পাইকারি নয়, খুচরা বিক্রিও হয় এ মার্কেটে। ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা নতুন করে বিনিয়োগ করেছিলেন। ব্যাংক ও স্থানীয় সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছিলেন অনেকে। অনেকে ঋণ নিয়েছিলেন পরিচিতদের কাছ থেকে। এসব বাজারে মৌসুমী বিনিয়োগও হয়। ২ বছরের কোভিড পরিস্থিতি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর এবারের ঈদ ঘিরে ব্যবসায়ীদের যে স্বপ্ন ছিল, মঙ্গলবারের আগুনে তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবাজারে এবারই যে প্রথম আগুন লেগেছে, তা নয়। এর আগে ১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় এই মার্কেট। নতুন করে গড়ে তোলার পর ২০১৮ সালেও সেখানে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে বঙ্গমার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিশ টানিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, ২০১৯ সালে তারাও মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। তার পরও ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। তখন বঙ্গবাজার মার্কেট সমিতি হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে আদালত নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেন।

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের কারণ তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে আট সদস্যের কমিটি করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। প্রতিবেদন দিতে তাদের সময় দেয়া হয়েছে তিন দিন।

শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি হয়। এসব কমিটি থেকে যেসব সুপারিশ করা হয়, তার কোনোটিই কি বাস্তবায়িত হয়? হলে কি এভাবে একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে বা ঘটতে পারে? দুর্ঘটনা যেকোনো সময় ঘটতে পারে। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর যে প্রশ্নগুলো সামনে চলে এসেছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ওই মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে ১০ বার নোটিশ দেয়ার কথা জানিয়েছে। এ ব্যাপারে মার্কেটের সামনে ব্যানারও টানায় তারা। তারপরও কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ১০ বার নোটিশ দিয়েছে। সেখানে ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়ার পর ব্যবসায়ী মালিক সমিতি হাইকোর্টে গিয়ে ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ নিলে এ পরিকল্পনা আর এগোয়নি।

তদন্ত কমিটিগুলো হয়তো অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করবে। কিন্তু এ জাতীয় দুর্যোগের নেপথ্যে আরও কোনো কারণ আছে কি-না, সেটাও অনুসন্ধান করে দেখা দরকার।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে, সাধ্যমতো নগদ অর্থ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকৃত সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীই আর্থিক সহযোগিতার তালিকাভুক্ত হবেন এমনটিই প্রত্যাশা। এ বিষয়ে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতি বিবেচ্য হতে পারে না। মানুষের এ অসহায়ত্ব নিয়ে কোনো ধরনের নোংরা রাজনৈতিক তৎপরতা থাকবে না- এমনটিই প্রত্যাশা। মনে রাখা দরকার, ধ্বংস-ক্ষতি-বিপর্যয়ের কোনো দল নেই; মত নেই।

 

মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ