ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মৎস্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিন

সাকিবুল ইসলাম
মৎস্য জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিন

এ বছর মৎস্য অধিদপ্তরের স্লোগান হলো- করলে জাটকা সংরক্ষণ-বাড়বে ইলিশের উৎপাদন। যা শুরু হয়েছে ১ এপ্রিল থেকে আজ ৭ এপ্রিল পর্যন্ত। যার নাম ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী যা মানুষের জীবিকা ও যাতায়াতের একটি বড় মাধ্যম। আমাদের দেশের মানুষের আমিষের অধিকাংশ চাহিদা পূরণ হয় এসব নদী থেকে পাওয়া মাছ থেকে। বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে মৎস্য জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মৎস্যবিজ্ঞানীদের মধ্যে আজ আর কোনো দ্বিমত নেই। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই মৎস্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বর্তমানে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হলেও তার মূল সুরটিই হচ্ছে দেশীয় মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ। কিন্তু বিষয়টি উপস্থাপন করা যতটা সহজ বাস্তবায়ন করা ততোটাই কঠিন। কারণ এর সঙ্গে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং অধিক মুনাফার আকাঙ্ক্ষাবিষয়ক নানাবিধ প্রভাবক ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু এ অন্তরায়গুলো দূর করা সম্ভব না হলে দেশের মৎস্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গৃহীত ব্যবস্থাপনাগুলো টেকসই করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস এবং উভয় প্রকৃতির জলাশয়ের মাঝে মাছ চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির নেপথ্যের কারণগুলোর অধিকাংশই কৃত্রিম। যেমন- অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, প্লাবনভূমিতে ধানচাষের ধাঁচে পরিবর্তন, জলাশয় দখল ও ভরাট এবং জলাশয়ের পানি দূষণ, আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ ও অধিকহারে পানি প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে নদীর মরে যাওয়া ইত্যাদি। সবগুলো বিষয়ই আবার একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আবার এসব কারণকে দূর করার জন্য যেসব ব্যবস্থাপনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই কৃত্রিম (যেমন- ফিশপাস তথা মৎস্যবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, ক্ষুদ্র পরিসরে অভয়াশ্রম নির্মাণ ইত্যাদি) যা আমাদের দেশের মতো গঠন প্রক্রিয়া চলমান এরকম একটি বদ্বীপের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কার্যকর হতে পারেনি, হওয়ার কথাও নয়। একটা মিথ্যা যেমন হাজারটা মিথ্যার জন্ম দেয় তেমনই প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি কৃত্রিম সংকটের সমাধানকল্পে নেয়া কৃত্রিম ব্যবস্থাপনা শুধু কৃত্রিমতাকেই বাড়িয়ে দেয়, সমস্যার টেকসই সমাধান পাওয়া সম্ভব হয় না।

মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র পুনরুদ্ধার এবং এবং উভয় জলাশয়ের মাঝে মাছ চলাচলের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হওয়া উচিত যেসব অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে জলাশয়ের ভূপ্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা অপসারণ করা এবং নির্মিত ও নির্মিতব্য রাস্তায় পর্যাপ্ত সেতুর ব্যবস্থা করা যাতে করে বৃষ্টি বা ঢলের পানি স্বাভাবিক গতিতে নদীর দুকূল ভাসিয়ে জমিকে প্লাবিত করে নেমে যেতে পারে। প্লাবনভূমিতে দেশীয় বর্ষালী ধান বা পাটের আবাদ কমতে থাকায় জলজ পরিবেশের যে পরিবর্তন ঘটেছে তার সঙ্গে দেশীয় মাছ খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। কারণ দেশীয় বর্ষালী ধান-পাটের ক্ষেতই হচ্ছে দেশীয় ছোট মাছের প্রধান প্রজননক্ষেত্র। আবার বাঁধ ভেঙে সৃষ্ট বন্যা স্বল্পস্থায়ী হওয়ায় দ্রুতগতিতে প্লাবিত হওয়া ও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পানি নেমে যাওয়া পৃথিবীতে আগত নতুন প্রজন্মের মাছ বড় হবার সুযোগ পাবার আগেই মানুষের খাবারে পরিণত হয় ফলে পরের বছরে পর্যাপ্ত মা-বাবা মাছের স্বল্পতা দেখা দেয় যা মাছের প্রজাতি হুমকির মুখে পড়ার প্রধান কারণ।

মাছের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণে আরও যেসব ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা জরুরি সেসব হলো- জলজ বনায়ন সৃজন ও টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন, জলাশয়ের স্বল্পমেয়াদি মুনাফামুখী বাণিজ্যিক ইজারা প্রথার পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি বিজ্ঞানসম্মত উৎপাদনভিত্তিক জৈবব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রচলন, উন্মুক্ত জলাশয় হতে মাছ আহরণের ক্ষতিকর উপকরণ ও পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, বৃহৎ পরিসরে অভয়াশ্রম স্থাপন ও তার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, প্লাবনভূমির কৃষিজমিতে পরিমিত সার ব্যবহার করা, ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিপন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন, চাষ ও উন্মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্তকরণ, বিদেশি মাছ আমদানির আগে দেশীয় মৎস্য প্রজাতি ও জলজ পরিবেশের এর প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণার পর ভালো ফলাফল সাপেক্ষে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া, সময় উপযোগী মৎস্য, জলাশয় ও পানিসম্পদ বিষয়ক আইন-প্রণয়ন ও প্রচলিত মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং মৎস্যজীবীসহ সব জনসাধারণের মধ্যে এবিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি।

শিক্ষার্থী

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত