ঐতিহাসিক ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিপ্রস্তর

হাসানুর রশীদ, গবেষক ও সাহিত্যিক

প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে ভারতবর্ষজুড়ে ভয়াবহ ও নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙা শুরু হয়েছিল। সে দাঙাই মূলত ভারতের দুটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের আলাদা দুটি দেশ গঠনের ইন্ধন জোগায়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতারা ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে দিখণ্ডিত স্বাধীন দুটি দেশ দাবি করে। ব্রিটিশ সরকার সেটা নেয়। ফলে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতবর্ষ ভেঙে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ ঘটনায় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের হিন্দু জমিদার শাসিত পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল। সে খুশির ঢেউ এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর শরীরেও লেগেছিল। তারা জেনেছিল, শুধু মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তান হচ্ছে। যে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থাকবে না, অশান্তি থাকবে না। আবার তারা জেনেছিল, নতুন দেশ তাদের ভাত দেবে, কাপড় দেবে, বাসস্থানের নিশ্চয়তা দেবে। জমিদার-পাইক-পেয়াদা ও সাদা চামড়ার সাহেবের অত্যাচার-অনাচার, চোটপাট থাকবে না। চাষবাসের জমির খাজনা লাগবে না। ফলে শতরকমের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি আকাঙ্ক্ষার ঘূর্ণায়নে তখন নব আনন্দের অশ্রুধারায় সিক্ত ছিল পূর্বাঞ্চলের মুসলিম বাঙালি। কিন্তু বাঙালি জাতির এই দিবা স্বপ্ন ভেঙে যেতে সময় লাগেনি।

স্বাধীনতা লাভের পরপরই পাকিস্তান সরকার বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজিকে পাকিস্তানের গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার অনুসারীদের বাদ দিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের সরকার গঠিত হয়। সে সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মিলে উর্দুকে পুরো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রশাসনে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রকোপ বাড়ে। পূর্ব-পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল খাদ্যসংকট দেখা দিতে থাকে। ফলে আঘাতের পর আঘাতে একেবারে অল্পসময়ের মধ্যে স্বাধীনতার বায়ুবাষ্পে উড্ডীয়মান বাঙালি সমাজের বিশ্বাস ও আস্থা ভেঙে যেতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাঙালি মুসলিম তরুণরা তাদের স্বপ্নের দেশ ও সরকারের বিপক্ষে হরতাল করে। আবার স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় এসে তাদের তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাদের কয়েকজনকে জীবন দিতে হয়। গ্রেপ্তারাতঙ্ক ও অত্যাচারে তাদের নীল হতে হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে রাষ্ট্রভাষা দাবির আন্দোলন বলা হয়। তবে সেটা বাহ্যিকভাবে সেটা হলেও কার্যত সেটা ছিল, সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যর্থতার প্রতিবাদ। তবে এ ঘটনার পরও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের জনমানুষের প্রত্যাশার গভীরে চোখ ফেলেনি। তারা পূর্ব-পাকিস্তানের জনমানুষের প্রত্যাশাকে চক্রান্ত ও ক্ষমতা প্রদর্শন করে অবদমন করে রেখেছে। ফলে তাদের বারবার আন্দোলনে যেতে হয়েছে। ১৯৬২ ও ১৯৬৬ গলিয়ে ১৯৬৯ সালে তাদের জনঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে হয়েছে। জীবন দিয়ে ১৯৭০ সালে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিতে হয়েছে। কিন্তু সে নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত দল আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করতে হয়েছে। তারপরও তারা পছন্দের সরকার পায়নি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সামরিক সরকার নির্বাচিত আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতা না পুরোনো চক্রান্ত নতুন মাত্রায় শুরু করে। রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণের জন্য ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়। ফলে পূর্ব-পাকিস্তানজুড়ে ভয়ংকর জনপ্রতিরোধ দেখা দেয়। এবারও পাকিস্তান সরকার বাঙালির জনপ্রতিরোধকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেনি। মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে কেন্দ্রীয় সামরিক সরকারপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঢাকায় আগমন ছিল কালক্ষেপণের পরিকল্পনা- পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্লাটুন প্লাটুন সৈন্য এনে ভয় দেখিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানকে বাগে রাখার ষড়যন্ত্র। ফলে আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ একেবারের অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিকভাবে ভেঙে গেল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আপস আলোচনা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসহীনতার সর্বশেষ পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান আলোচনার গৃহীত সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে না জানিয়ে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান চলে গেলেন। সে রাতেই শুরু হলো সহস্রাব্দের ভয়ংকর গণহত্যা-অপারেশন সার্চলাইট। রাতে ঘরেফেরা মানুষরা রাস্তায়, রিকশায়, গাড়িতে লাশ হয়ে পড়ে রইল। বাসা-বাড়ি, হোস্টেল-হলে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষ আর সকাল দেখতে পেল না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গোপনে ঢাকা ত্যাগ এবং সে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বঙ্গবন্ধুকে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করল যে, আর আলোচনার সুযোগ নেই। ফলে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের মধ্যপ্রহরে জাতিকে আত্মরক্ষার আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। আর তার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলো।

২৫ মার্চের ভয়ংকর গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের ঘটনা দেশবাসীর মতো আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ভীত ও সতর্ক করে দেয়। তারা খুব দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকেন। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল করা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ধানমন্ডি থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ৩০ মার্চ তারা মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় পৌঁছান। মেহেরপুরের তৎকালীন ডিসি তওফিক এলাহী ও ঝিনেদার এসডিপিও মাহবুবউদ্দীন তাদের কলকাতায় যেতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। সে স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন :

‘তওফিক এলাহী ও মাহবুবকে বিদায় দিয়ে মজুমদারের জিপে চড়ে আমি ও তাজউদ্দীন ভাই কলকাতা যাত্রা শুরু করি। মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এ ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। তার এ কথা শুনে আমরা কিছুটা আশ্চর্য হই। রাতেই তার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে। আমাদের আগমনের কথা শুনেই মজুমদার দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জিপ থেকে নামিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত বড় কালো রঙ-এর একটি গাড়িতে তোলা হলো। বিমান থেকে ৬ ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী। রুস্তমজী এক সময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর নিরাপত্তা প্রধান ছিলেন। নেহেরু পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।’

ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তমজীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রবাসী সরকার গঠন, পরিচালনা ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আলোচনা করেন- সহযোগিতাও চান। কিন্তু তার পক্ষে সহযোগিতা করার বিষয়ে মতামত দেয়া সম্ভব ছিল না। ফলে রুস্তমজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন।

১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাকে নিশ্চিত করেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র লোকদের হত্যা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের বাড়টি কথাটুকু তাকে বলতে হয়েছিল। তারপর তাজউদ্দীন আহমদ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে উপযুক্ত সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন। এ সাক্ষাৎকার সম্পর্কে মঈদুল হাসান ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে লিখছেন :

‘একাত্তরের ৩ এপ্রিল রাতে তাজউদ্দিন আহমেদকে ১ সফদর জং রোডের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন পৌঁছান, মিসেস গান্ধী তখন দীর্ঘ বারান্দায় হাঁটছিলেন। তাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরার প্রশ্ন ছিল, শেখ মুজিব কোথায়? উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তিনি গ্রেপ্তার হলেন কেন? তাজউদ্দিন তাকে বলেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সরকার গঠন করেছেন, তারপর একটা বিভ্রাটে পড়ে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার এ কথায় ইন্দিরা গান্ধীর সংশয় কাটেনি।’

পরবর্তীকালে তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় ফিরে দ্রুত সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু সে সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কে কোথায় আছেন, সে বিষয়টি তার জানা ছিল না। ফলে তিনি দ্রুত সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেও কিছুটা সময় নিতে চাচ্ছিলেন। এ সময় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাকে অতিদ্রুত অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠনের জন্য বলতে থাকেন। সে সময় একটি সরকার গঠনের জটিলতার দিকটি বিবেচনা করে তাজউদ্দীন আহমেদ তাকে বলেন :

‘আপনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জানেন না, সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন করে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।’ (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি)

প্রকৃত অর্থেই পরবর্তীকালে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসে। অবশ্য অল্পসময়ের মধ্যে প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য কমিয়ে আনেন। অবশেষে প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার এবং টেলিযোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন ও প্রশাসন মন্ত্রণালয় নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী, এম মনসুর আলীকে অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহণ বিষয়ক মন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষিবিষয়ক মন্ত্রী করে বাংলাদেশ অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করেন। তারপর তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একটি ভাষণ রেকর্ড করেন এবং সে ভাষণটি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। সে ভাষণে তিনি বলেন :

‘স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাই-বোনরা, ‘বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস, কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব-পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এ পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে গেলে চলবে না, যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং এর সত্যিকারের অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে, এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ।

১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের এক আবেগময়ী এবং ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্য শক্তি সঞ্চার করে। বলা হয়, ১০ এপ্রিল ও এদিনের এই ভাষণ ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।