ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোগী চিকিৎসা এবং অপচিকিৎসা

মাহমুদুল হক আনসারী, সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট, [email protected]
রোগী চিকিৎসা এবং অপচিকিৎসা

ডাক্তার ও চিকিৎসা বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। রোগীর অভিযোগের শেষ নেই। মানুষের রোগব্যাধি হবে। সেটি প্রাকৃতিক নিয়ম। নানান নিয়ম-অনিয়মের কারণে মানবদেহে রোগের সৃষ্টি হয়। সে রোগের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসাশাস্ত্র রয়েছে। সমাধানও আছে। ডাক্তার আছে, মেডিকেল ক্লিনিক, কলেজ ও হাসপাতাল ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পৃথিবীর উন্নতি অগ্রগতির সঙ্গে বৈজ্ঞানিকভাবে মানবদেহের চিকিৎসার উন্নতি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে সরকার প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। নতুন নতুন চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অসংখ্য মেডিকেল ক্লিনিক আছে। মানুষের মধ্যে নানাভাবে রোগব্যাধী তৈরি হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন, চালচলন, অভ্যাসের কারণে মানবদেহে মরণব্যাধীসহ নিত্যনতুন রোগের সৃষ্টি হয়।

খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের নানা অনিয়ম থেকে রোগের সৃষ্টি। খাদ্যের নামে ভেজাল খাদ্য গ্রহণ রোগের অন্যতম কারণ। তবুও মানুষকে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য দেশে উৎপাদিত নানাজাতের খাদ্যসামগ্রী মানবসমাজ শরীরের জন্য গ্রহণ করছে। খাদ্যের মান ও দাম কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে, সেটিও দেখার অনেক সময় সুযোগ হয় না। প্রয়োজনের কারণে ব্যক্তি পরিবার আত্মীয়-স্বজনের জন্য খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করে গ্রহণ করতে হয়। এসব ভেজাল খাদ্যের ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যের মান ভেজাল প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ মোটেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। প্রতিদিন খবরের কাগজে এবং নানা সংবাদমাধ্যমে ভেজাল খাদ্যবিরোধী অভিযানের সংবাদ পাওয়া যায়। অনেকগুলো ভেজাল খাদ্য উৎপাদন কারখানা মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযানে তাদের জরিমানাসহ প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করে দেয়ার সংবাদ আছে। তবুও ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ মোটেও রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রোগব্যাধির নিয়ন্ত্রণ মানবদেহে মোটেও রক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে মানবদেহে নানান জটিল ও কঠিন রোগ তৈরি হচ্ছে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়। ডাক্তারের কাছে গেলেই বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্য বিরাট একটি তালিকা দিয়ে ল্যাবের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। লম্বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে প্রচুর অর্থ খরচ করে ভোক্তভোগী রোগী। তার কাছে অর্থ থাকুক বা না থাকুক, ধারকর্য করে হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ল্যাবের সব পরীক্ষগুলো শেষ করে ওই ডাক্তারের কাছে পুনরায় যাওয়া হয়। দেখা যায় অনেক সময় ৮ থেকে ১০টি পরীক্ষা করার পরও রোগীর প্রকৃতপক্ষে কোনো রোগই পাওয়া যায়নি। তখন ডাক্তার রোগীকে তার সাধ্যমতো চিকিৎসার একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেয়। সেখানে অনেক ধরনের আইটেমের ওষুধ দেয়া হয়। দেখা যায় সেই চিকিৎসায় রোগীর দুই পয়সারও লাভ হয়নি। টাকা কিন্তু প্রচুর খরচ হয়েছে। কয়েকমাস ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে যাতায়াত করতে হয়েছে। মোটেও রোগীর কোনো আরোগ্যতা আসেনি। চিন্তায় পড়ে যায় রোগী। তার অসুস্থতা বাড়তে থাকে। দিন দিন সে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। চিকিৎসা এবং ওষুধে রোগীর কোনো কল্যাণ সে পাচ্ছে না। তখন তার মাথায় এসে যায় দেশে হয়তো আমার চিকিৎসা হবে না। আমাকে দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে। টাকা লাগবে পাসপোর্ট লাগবে, ভিসা লাগবে সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কাউকে সঙ্গী করে নিতে হবে। বিরাট এক খরচ এবং ভোগান্তির মধ্যে পড়ে গেল সে রোগী। যেভাবেই হোক তাকে অর্থকরি জোগাড় করে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে কেন? আমাদের দেশে এতো মেডিকেল কলেজ এতো চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ থাকার পরও কেনো জনগণ রোগের সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না? সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চিকিৎসকরা জনগণের টেক্সের অর্থে পড়ালেখা করে ডাক্তার হয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করে কলেজ থেকে বের হয়ে সে সঠিক রোগের চিকিৎসা প্রায় বুঝে না। তাহলে এসব মেডিকেলে চিকিৎসকের নামে কী তৈরি হচ্ছে। অনেকগুলো কথা। এতগুলো কথা বলা লেখা মোটেও আমি সমুচিত হবে বলে মনে করছি না। মনের দুঃখে রোগীদের নানা যন্ত্রণা এবং ভোগান্তির কথা শুনে লেখাটি লিখতে হচ্ছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেসব ডাক্তার কর্মরত রয়েছেন তাদের বেশিরভাগ ডাক্তারের রোগীর প্রতি ব্যবহার মোটেও সন্তোষজনক নয়। মনে হয় তারাই রাজা, তারাই মালিক। আর রোগী একজন প্রজা তাদের কর্মচারী। ভালো ব্যবহার আচার-আচরণ কোথাও চোখে পড়ে না। সঠিক সময়ে চেম্বারে আসে না। যে কয়জন ডাক্তার কর্মচারী হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ আছেন, এসে কয়েক ঘণ্টা পর সরকারি চেম্বার ত্যাগ করে উদাও হয়ে যায়। ইচ্ছেমতো চেম্বারে আসা এবং চলে যাওয়ার প্রবণতা নিয়মিতভাবে চোখে পড়ার মতো। এ হলো সরকারি চিকিৎসা সেন্টারের পরিস্থিতি। এরপর যেসব রোগীরা কিছু চিকিৎসা পায় তাও মাথাব্যথা, পেটব্যাথা, গ্যাস্টিক জাতীয় রোগের জন্য কিছু চিকিৎসা আর মেডিসিন সহজভাবে নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। এর বাইরে জটিল রোগের চিকিৎসা মোটেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে সহজভাবে রোগীরা পাচ্ছে না। বাইরে চেম্বারে গিয়ে প্রাইভেট ফি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে সরকারি সেই ডাক্তারদের দেখাতে হয়। সেখানেও অনেক ভোগান্তির পর রোগী চিকিৎসা না পেয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে চলে যায়।

এগুলো অবশ্যই আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। চিকিৎসাকে সহজ এবং সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ডাক্তারদের মানবিক হওয়ার কঠোরভাবে অনুরোধ করছি। চিকিৎসা খাত একটি মানবিক এবং অত্যন্ত জরুরি সেক্টর। অপরাপর সেক্টরের মতো চিকিৎসা খাতকে হিসাব করা যাবে না। চিকিৎসা এবং এ খাতের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের মানবিক দৃষ্টির মধ্যে রোগের চিকিৎসা করতে হবে। রোগীর সামর্থ্য ক্ষমতা দেখে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। জটিল কঠিন রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারি বরাদ্দ থাকা চাই। কিছু বরাদ্দ থাকলেও সেটি অপ্রতুল। এটিকে আরও ব্যাপকভাবে করার দাবি জানাচ্ছি। ডাক্তারদের মানবদরদী রোগীপ্রেমিক হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। সরকারি চিকিৎসা খাতকে দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চাই। বেসরকারি চিকিৎসা খাতের গলাকাটা অর্থ আদায় বন্ধ করতে হবে। তাদের একটি নির্দিষ্ট নিয়মের ক্লিনিক ও ল্যাব পরিচালনার কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ঠিক করে দিতে হবে। এর বাইরে ইচ্ছেমতো অর্থ আদায় করা রোগীদের ভোগান্তির মধ্যে ফেলে ইচ্ছেমতো অর্থ আদায় বন্ধ করতে হবে। সঠিক চিকিৎসা প্রাপ্তি এবং রোগ নির্ণয় যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থ রোগের জন্য বাইরে পাচার অনেকটা বন্ধ হবে। আসুন চিকিৎসা প্রাপ্তির জন্য দেশের বাইরে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করি এবং চিকিৎসাকে রোগীদের নাগালের মধ্যে রাখি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত