ফ্যাক্টাম ভ্যালেট মনোভাব এবং আমাদের দায়বদ্ধতা

আসাদুজ্জামান বুলবুল, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তোমাদের কথায় কথায় এতো ব্যকরণ, তোমাদের উঠতে বসতে এতো অভিধান, কিন্তু চঞ্চল ঝর্ণার কোনো ব্যাকরণ নেই, আকাশের কোনো অভিধান নেই, সমুদ্রের নেই। ভালোবাসা ব্যাকরণ মানে না কখনো; হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো সংবিধান নেই।

মহাদেব সাহার কোথা সে প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ কাব্যগন্থের ছন্দরীতি কবিতার মতো আমাদের সমাজেরও বর্তমানে কোন ব্যকরণ নেই। নেই কোন ছন্দরীতি, দেশ চলছে চঞ্চল ঝর্ণার অবাধ্য নিয়মে।

বোধকরি সমাজপতিরা ছন্দরীতি কবিতার দ্বারা আবার অনুপ্রাণিত হয়েছে কিনা কে-বা জানে। আমরা যারা বাংলা ভাষাভাষী তারা পড়াশোনা করতে গিয়ে জীবনের একটা সময় বাংলা ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। সেখানে নিপাতনে সিদ্ধ সমাস, সন্ধি ও প্রত্যয় নামে কিছু পড়াশোনা ছিল। এই টপিকগুলো নিপাতনে হওয়ার কারণ ছিল বেশ মজার। নিয়মের নিপাত বা লংঘন হলো নিপাতন অর্থাৎ নিয়মের তোয়াক্কা না করে এসব অনায়াসে আমাদের কাঁধে চেপে বসে আছে। ব্যাকরণের নিপাতনে সিদ্ধের মতো কিছু লোক নিয়ম ভেঙে কিছু করেছে; কিন্তু লোকে করেই ফেলেছে বলে সেটাকেই মেনে নেওয়া হচ্ছে ফ্যাক্টাম ভ্যালেট মনোভাব। অর্থাৎ ঘটনা যখন ঘটে (ফ্যাক্ট) গেছে, তখন সেটাকে ভ্যালিড (স্বীকৃত) বলে মেনে নিলেই ভালো। লোকে যেটা করেই ফেলছে, সেটা আগের চালু নিয়ম ভেঙেই হচ্ছে; কিন্তু নিয়ম ভাঙাই এখন নতুন নিয়ম। অনিয়ম যখন নিয়ম হয়ে যায়, তখন ঘটে নিপাতন-সিদ্ধতা। ভাষা, ধর্ম আর সংস্কৃতিতে এটা প্রায়ই ঘটে। ধ্বনি-বিপর্যয় ঘটে পিশাচ হয়ে যায় পিচাশ, সাধু হয়ে যায় সাউধ।

যাইহোক আমাদের এই দায়সারা ফ্যাক্টাম ভ্যালেট মনোভাব বা সবকিছু সয়ে যাওয়া মেনে নেওয়ার নীতি কীভাবে আমাদের ক্ষতি করছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। প্রতি বছর বর্ষাকালে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় আমাদের দেশে। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বৃষ্টিপাত একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কিন্তু আশীর্বাদস্বরূপ এই বৃষ্টি, শহরবাসীর জন্য হানিকর। দেশ স্বাধীন হয়েছে পাঁচ দশক হয়ে গেল, কিন্তু এখনও আমাদের সময়োপযোগী কোনো নগর পরিকল্পনা নেই। একদিনের বৃষ্টিপাতে বড় শহরের রাস্তাগুলো হয়ে যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। একটি দেশের পানি নিষ্কাশন এবং নগর ব্যবস্থাপনা এতটা নাজুক হতে পারে তা বোধহয় বঙ্গদেশে জন্ম না নিলে বিশ্বাস হতো না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমরা এই জলাবদ্ধতাকে ধারণা করেছি এখন আমরা সয়ে গিয়েছি, মেনে নিয়েছি।

আমরা ধরেই নিয়েছি বৃষ্টি হলে আমাদের রাস্তাঘাট ডুবে যাবে। আবার বাংলাদেশে রমজান মাস শুরু হলে দেখা যায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মহরত। ব্যবসায়ীরা নিয়ম করে ফেলেছে রমজানে মানুষের পকেট ফাঁকা করতে হবে। আর আমরাও মেনে নিয়েছি রমজানে তো জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। এই যে অনিয়ম কিছু হচ্ছে আর আমরাও অনায়াসে মেনে নিচ্ছি, এই মানসিকতা হচ্ছে ফ্যাক্টাম ভ্যালেট মনোভাব আর এই মানসিকতাকে পুঁজি করে সমাজের সর্বস্তরে চলছে নৈরাজ্য। যারা স্বার্থান্বেষী তারা ধরেই নিয়েছে আমরা কিছু করলে সাধারণ জনগণ তা মেনে নেবেন।

প্রতি বছরে ঈদযাত্রার সময় আর এক নৈরাজ্য এবং হৃদয়বিদারক ঘটনা সাক্ষী হতে হয় প্রতি বছর আমাদের। ঈদে মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য যানবাহনের টিকিট পায় না আর পেলেও চড়ামূল্যে দিয়ে কিনতে হয়। আবার টিকিট কিনলেও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আর পরিবারের সঙ্গে দেখা হয় না অনেকের। এখন ইদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আমরা ধরেই নিয়েছি ঈদে বাড়ি ফেরার সময় ভোগান্তি হবে, রাস্তায় মরতে হবে। আমরা প্রশ্ন করি না কেন আমাদের ঈদের সময় প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মরতে হবে রাস্তায়? কেন ঢাকা শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে ট্রাফিক জ্যামে? কেন এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ডুবে যায় আমাদের রাস্তাঘাট? কেন প্রতি বছর মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্য দেখতে হয়?

মাঝেমাঝে মনে হয় আমরা বোধহয় চৌচালাহীন ওই ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষটির মতো। ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষগুলো এত বেশি মশার কামড় খায়, একটা সময় গিয়ে তাদের কাছে এটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের পরিক্রমায় আমরা থাকব না। মহাকালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাব। আসুন না, আমরা সুন্দর গোছানো একটি বাংলাদেশ উপহার দিয়ে যাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। দেশ হচ্ছে মায়ের মতো, মা যেমনি হোক সবসময় সুন্দর তার সন্তানের কাছে।

এই দেশমাতৃকার ভালোবাসায় সব নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান রইল চলুন সুন্দর, সুশৃঙ্খল একটি বাংলাদেশ গড়ি।