প্রাইমারিতে বায়োমেট্রিক হাজিরা

প্রকল্পটির ব্যর্থতার দায়ভার নেবে কে?

প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রূপকল্প বর্তমান সরকারের প্রধান এজেন্ডা। লক্ষ বাস্তবায়নে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। এ উদ্যোগেরই অংশ হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু করতে চেয়েছিল সরকার। পরিতাপের বিষয়, প্রায় শতকোটি টাকা বাজেটের এই প্রকল্প ভেস্তে গেছে অঙ্কুরেই। প্রকল্প বাতিল হলেও এরই মধ্যে জলে গেছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা হয়েছিল হাজিরা মেশিন। এই ক্রয়েও অভিযোগ রয়েছে জালিয়াতির। ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে অধিকাংশ যন্ত্রাংশ। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষকদের ডিজিটাল হাজিরা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে সময়ের হিসাব অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার ৬২০টি। এই সব প্রতিষ্ঠানে বায়োমেট্রিক হাজিরা স্থাপন করতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়। এর পরই কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা হয় এই মেশিন। কিন্তু এর পরই করোনার দীর্ঘ সময় অফিস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মন্থর হয়ে যায় বায়োমেট্রিক কার্যক্রম। যন্ত্রটি চালু রাখতে প্রয়োজন হয় বিদ্যুৎ সংযোগ, ইন্টারনেট কানেকশন ও কম্পিউটার। বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ ও কম্পিউটারের অপ্রতুলতায় ভেস্তে যায় এই কার্যক্রম। এখন ব্যবহার না হতে হতে রীতিমতো জঞ্জালে পরিণত হয়েছে মেশিনগুলো। আবার যন্ত্রটির ব্যবহার না হলেও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অনলাইন চার্জের নামে হাজার হাজার টাকা দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির বিষয়টি প্রায়ই শোনা যায়। শিক্ষার পরিবেশ ও মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ইদানীং আবার এমনও অভিযোগ রয়েছে, প্রধান শিক্ষকসহ অনেকে রাজনীতি ও সামজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। সম্ভবত এই কারণে অনুপস্থিতির ঘটনা ঘটছে। ফলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি শিক্ষকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষাদান হবে কী করে? এই অর্থে এটা একটি ইতিবাচক উদ্যোগ ছিল বলা যায়। কিন্তু সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে যা হয়, এখানেও তা হয়েছে। সূত্র মতে, প্রধান শিক্ষকরা অনেক সময় শিক্ষা অফিসে, বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ফলে বায়োমেট্রিক হাজিরা থাকলে তাদের এসব অনুষ্ঠানে যেতে সমস্যা হয়। তাই ব্যর্থতা কারও কারও কাম্য ছিল। আবার এই প্রকল্প চালুর পরপরই করোনার কারণে স্কুল বন্ধ ছিল। অনেক স্কুলে এটি দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক স্কুলে সচল থাকার পরও সেটিকে বিকল হিসেবে শিক্ষা অফিসে রিপোর্ট করা হয়। এই ভাবে প্রকল্পটি সাফল্য লাভ থেকে দূরে সরে যায়। মাঝখান দিয়ে জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনষ্ট হলো।

ডিজিটাল হাজিরা এক ধরনের নজরদারি ব্যবস্থাপনার মতো। কর্তৃপক্ষ সরাসরি উপস্থিত না থেকেও শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় এই ব্যবস্থায়। এতে করে শিক্ষক হয়েও শিক্ষাদানের চেয়ে অন্য কাজে যারা ব্যস্ত, তাদের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। পাশাপাশি একটি পক্ষ তো ওতপেতে থাকে সরকারি প্রকল্পের অর্থ নয়ছয় করার জন্য, এখানেও এটা হয়েছে বলে প্রকাশ। তাই এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল হাজিরা শতভাগ স্কুলে দেয়া বা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। প্রশ্ন হলো, প্রকল্প প্রণয়নের সময় কি কর্তৃপক্ষ এর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছিল? প্রকল্পটি ভেস্তে যাওয়ার দায় কি তারা এড়াতে পারবেন? সংগত কারণেই যে কোনো প্রকল্প প্রণয়নের সময় অবশ্যই এর উপযোগিতা ও টেকসই বাস্তবায়নের কথা ভাবতে হবে। আর শিক্ষকদের তো উচিত তাদের পেশা, শিক্ষাদান এবং দায়বদ্ধতা থেকে যথাযথভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা। বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন তাদের জন্য সুখকর হওয়ার কথা নয়। অতএব প্রাথমিকের শিক্ষকরা নিজ দায়বদ্ধতা থেকেই নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকবেন- এটাই প্রত্যাশা।