ক্ষুধা-দারিদ্র্যে ঘরছাড়া পথশিশু

সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে

প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এক সময় আমরা যাদের ‘টোকাই’ বলতাম, তাদের এখন ‘পথশিশু’ নাম দিয়েছি। তাদের নাম বদল হয়েছে; কিন্তু অবস্থার আদৌ পরিবর্তন হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে এখনও ক্ষুধার তাড়নায় ঘর ছেড়ে শিশুরা পথশিশুর তালিকায় নাম লেখাচ্ছে। আর দেশে রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশুরা চরম দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগ, নিরক্ষরতা, সহিংসতাসহ নানা বঞ্চনার শিকার। মর্মান্তিক জীবন কাটে রাস্তায় বাস করা এসব শিশুর। তাদের শোচনীয় এই পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে ‘পথশিশু জরিপ ২০২২’-এ। জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার কারণে সবচেয়ে বেশি শিশু ঘর ছেড়ে পথে বসবাস করে। পথশিশুদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রধানত দারিদ্র্য ও ক্ষুধার তাগিদে ঘর ছাড়ে। সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা এ জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সরকারি সংস্থার এই জরিপটিকে অবশ্যই আমরা আস্থায় নিতে পারি। এদিকে ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি হতে পারে। যেসব শিশু তাদের পরিবারসহ বা পরিবার ছাড়া বসবাস বা জীবিকা অর্জনের জন্য বেশিরভাগ সময় রাস্তায় কাটায়, তাদের রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। উল্লেখ্য, ঢাকা এবং দেশের ৮টি বিভাগের যেসব এলাকায় পথশিশুরা বেশি থাকে, সেসব এলাকায় ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি ৭ হাজার ২০০ শিশুর কাছে সরাসরি গিয়ে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

জরিপে আরও কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে যা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রণয়নে সহায়ক হতে পারে। যেমন পথশিশুর প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন (৩০ শতাংশের বেশি) জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন ঘুমানোর জন্য বিছানা এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন একটি ঘর থেকে বঞ্চিত। তারা পাবলিক বা খোলা জায়গায় থাকে ও ঘুমায়। প্রায় অর্ধেক শিশু মাটিতে ঘুমায় শুধু একটি পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরো বা একটি পাতলা কম্বল নিয়ে। পথশিশুদের প্রতি যে মানুষ সংবেদনশীল নয়, তাও জরিপে স্পষ্ট হয়েছে। যেমন রাস্তায় বসবাসকারী শিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় পথচারীদের দ্বারা। জরিপে অংশ নেয়া শিশুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করে। আর জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহ, ভিক্ষাবৃত্তি বা চায়ের দোকানে, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করতে বাধ্য হওয়া এই শিশুরা প্রতিদিন আঘাত ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। জরিপে অংশ নেয়া শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ শিশু কাজ করার সময় আহত হওয়ার কথা জানায়, আর অর্ধেক শিশু জানায় সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা। রাস্তায় থাকা শিশুদের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন (৭১ দশমিক ৮ শতাংশ) পড়তে বা লিখতে পারে না, যা জীবনভর তাদের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে রয়ে যায় এবং তাদের নির্মম ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। আশ্চর্য যে, তারা এমন এক জীবনের অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, ৬৪ শতাংশ পথশিশু তাদের পরিবারে ফিরে যেতে চায় না। বাবা-মা ফেরত নেন না ২১ দশমিক ৩ শতাংশ পথশিশুকে। ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর কোনো পরিবারই নেই।

পথশিশুদের নিয়ে জরিপে প্রাপ্ত তথ্য, আমাদের স্তম্ভিত করে। এদের কেউ ধূমপান ও মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেপরোয়া জীবনচর্চায় স্বাভাবিকতা তারা হারাতে বসেছে। এদের সমাজের মূলধারায় আনতে হলে সহযোগিতা ও সহানুভূতি প্রয়োজন। আর প্রতিবেদনে উঠে আসা বাস্তব চিত্র দেশের পথশিশুদের পরিস্থিতি মোকাবিলায় নীতিমালা প্রণয়ন ও কর্মসূচি গ্রহণে সহায়ক হবে। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ।