বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও অনন্য উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপন

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালির এক অনন্য উৎসব। কারণ, পৃথিবীর বেশির ভাগ উৎসবের উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত; কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কোনো ধর্মীয় সম্পর্ক নেই। এর প্রচলন হয় প্রধানত কৃষি ও কর আদায়ের ব্যবস্থাকে ঘিরে। পরে এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব নিষ্পত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল। দিনে দিনে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপন একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পহেলা বৈশাখ ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষের প্রাণের উৎসব।

বাংলা নববর্ষ কখন শুরু হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস নেই। কারণ বাংলা সন কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস অদ্যাবধি কেউ বলতে পারে না। বিভিন্ন প্রমাণের ভিত্তিতে এ বিষয়ে চারটি মত রয়েছে। বাংলা বর্ষের প্রবর্তক হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে- তারা হলেন রাজা শশাঙ্ক, মুঘল সম্রাট আকবর, সুলতান হোসেন শাহ এবং তিব্বতের রাজা স্রাংসান। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতদের অধিকাংশের মতে আকবর হলেন বাংলা সালের প্রবর্তক।

বাংলা নববর্ষ উদযাপন এদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখ উৎসবের মধ্য দিয়ে এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে দেশের মানুষ। বৈশাখী মেলায় দল-মত নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা বন্ধুত্ব এবং সম্প্রীতির একটি উদার মিলন স্থানে পরিণত হয়। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই মেলায় আসেন। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনোদনের সঙ্গেও যুক্ত।

বাঙালির এ উৎসব বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বাংলা নববর্ষের এ ঐতিহ্য মাটি ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত; এখানে কোনো জাত-পাত নেই। পহেলা বৈশাখের উৎসব শুরুতে ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। গ্রামের মেলা, খেলা ও নাচ-গান ছিল প্রধান আকর্ষণ। দিনে দিনে তা শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এ অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

এ সাংস্কৃতিক উৎসব ও চেতনা এদেশের বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। ১৯৬০ এর দশকে, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বার্ষিক উৎসব বাঙালির সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামসহ বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামকে প্রেরণা দেয়। বৈশাখের সংস্কৃতি আমাদের জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনন্য নৃতাত্ত্বিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলা নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব।

পহেলা বৈশাখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো এ সার্বজনীন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সব শ্রেণি, পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে অংশ নিতে আসা নারীদের মাথায় ফুল, মুখে আলপনা, পুরুষদের হাতে পতাকা, নানা আয়োজন আমাদের কষ্ট-দুঃখ লাঘব করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলা নববর্ষ একটি বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। দিন দিন এর পরিধি ও ব্যাপকতা বাড়ছে। বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোও এর পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বর্তমান পদ্ধতি খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনা বটমূলে নববর্ষের উৎসবের অনুষ্ঠান করে আসছে এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে এটির কলেবর বেড়েছে।

পহেলা বৈশাখ এবং বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনা করা হলেও আধুনিক সময়ে এর একটি নতুন নাগরিক রূপান্তর ঘটেছে। আর এর কারণ বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বলে অনেকে মনে করেন।

এখন এই উদযাপনের আচার একেবারেই নাগরিক। পান্তা-ইলিশ খেয়ে গ্রামীণ ভাব আনার চেষ্টা থাকলেও গ্রামের সঙ্গে নেই কোনো যোগসূত্র। নতুন বছরে ভালো খাবার খান গ্রামবাসীরা। তারা মনে করেন, নববর্ষের দিনে ভালো খাবার খেলে সারা বছর ভালো খাবার খেতে পারবেন। বরং শহরের নববর্ষ উদযাপনে পশ্চিমা নববর্ষ উদযাপনের অনুকরণই বেশি দেখা যায়।

বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন আর আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের স্বাভাবিক অংশ নয়। কারণ আমরা আর পুরোপুরি কৃষিনির্ভর সমাজের বাসিন্দা নই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়মেই চলে নতুন বছর বরণের আয়োজন। যার মধ্যে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ উদযাপনের কোনো আয়োজন না থাকলেও বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার একটা অবিরাম প্রচেষ্টা রয়েছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন।

বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, সাম্প্রদায়িক চেতনা, আকাশ সংস্কৃতির ক্রমাগত প্রভাব ইত্যাদি যখন বিশ্বের শত শত জাতি ও সংস্কৃতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে, তখন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সর্বজনীন উৎসব, যাতে বাংলার জাতি, পেশা, লিঙ্গ, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ অংশগ্রহণ করে। সেদিক থেকে বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব। আর সে কারণেই পাকিস্তানি আমলে বাংলা নববর্ষকে বিজাতীয়, বিধর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, বাংলা নববর্ষ উৎসবকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা ব্যর্থ হয়। বাংলা নববর্ষ উদযাপন হয়ে ওঠে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এটি এখন আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে এটি আসলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। যদিও আমাদের কাজ এবং সামাজিক জীবন সারা বছর পশ্চিমা বর্ষপঞ্জী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, অন্তত এ একটি দিনে আমরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলা বর্ষ পালন করি। তবে মধ্যবিত্তের জন্য বাংলা বর্ষ শুধু একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বাংলার কৃষকদের কাছে বাংলা সন-তারিখ তার গুরুত্ব হারায়নি। যদিও হাইব্রিড বীজের কারণে শস্য রোপণ এবং ফসল কাটাতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বৈশাখ এখন আর ঘরে ফসল তোলার একমাত্র সময় নয়, তবুও বাঙালি কৃষক তার সব কর্মকাণ্ডে বাংলা তারিখই অনুসরণ করে। কৃষির ওপর নির্ভরশীল কোটি কোটি মানুষ বাঙালি সনকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যেহেতু এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেহেতু তারা এখনও নিশ্চিত নয় কোনটা মেনে নেবে, আর কোনটা প্রত্যাখ্যান করবে।

মূলত নতুন ধনিক শ্রেণি মূল ঐতিহ্য ভুলে করপোরেট সংস্কৃতির চাপে ইংরেজি নববর্ষের রীতিতে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু করেছে। তারা যেভাবে নববর্ষ উদযাপন করে তার সঙ্গে বাংলা নববর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই। গ্রামাঞ্চলে পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছ খেয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় না। পরিবর্তে, সবাই সেদিন ভালো খাবার খাওয়ার চেষ্টা করে। আর পহেলা বৈশাখের দিনটা শুরু হয় একটু মিষ্টি খাবার দিয়ে। তারপর মেলা বসে। যা পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মেলা বসে গ্রামের বাজারে, মাঠে বা শহরতলির খেলার মাঠে। পালিত হয় সাংস্কৃতিক উৎসব।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও অনন্য উৎসব যা আমাদের ঐক্যের কথা বলে। এই দিনে সবাই অপ্রতিরোধ্য আনন্দে ফেটে পড়ে। পুরাতনকে জলাঞ্জলি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। পৃথিবীতে এমন নির্মল উৎসব আর নেই। দীর্য় সময় ধরে চলা করোনা মহামারি ও যুদ্ধ আতঙ্ক কাটিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক জাগরণ বেগবান হোক এটাই প্রত্যাশা। সবাইকে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০-এর আন্তরিক শুভেচ্ছা।