বাংলা নববর্ষে ঈদ, ঈদপর্বে নববর্ষ

মো. জিয়াউল হক হাওলাদার, ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রখ্যাত কবি T.S Eliot তার ‘The Waste Land’ কবিতায় এপ্রিল মাসকে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস হিসেবে আখ্যায়িত করলেও উৎসবমুখর বাঙালি জাতির জন্য এ মাসটি হচ্ছে দ্বিগুণ আনন্দের। এপ্রিল হচ্ছে বাঙালিদের ঋতুরাজ বসন্তের মাস। ইলিয়টের কবিতার ঊষোর পোড়ো জমির বিপরীতে আমাদের দেশ এপ্রিলে হয়ে উঠে সবুজ ও সতেজ। কোকিলের গানে আবির্ভূত হয় নববর্ষ। এবার এপ্রিলে আমাদের জন্য একদিকে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০-এর আগমন, অন্যদিকে হচ্ছে ঈদুল ফিতর। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে একই মাসে দুটি উৎসব পালিত হবে বাংলাদেশে। তার আগে ২৬ মার্চ পালিত হয়েছে বাংলাদেশের ৫১তম স্বাধীনতা দিবস। এটিও আমাদের জন্য মহাআনন্দের।

ঈদ এবং বৈশাখীর উৎসবে সবাই মাতোয়ারা হচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা, পর্যটক এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সবাই প্রস্তুতি নিয়েছে যার যার অবস্থান থেকে। এবার পর্যটন শিল্পের আয় সব মানদণ্ডে উপরের দিকে থাকছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে এই দুটি দিবসে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প সবচেয়ে বেশি আয় করতে পারবে। অন্যদিকে ১২ এপ্রিল হচ্ছে বৈসাবি উৎসব। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আদিবাসী জনগোষ্ঠী-চাকমা, ত্রিপুরা এবং মারমা মানুষরা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার যে উৎসব পালন করে তাই হচ্ছে বৈসাবি। এই উৎসবকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বলে বৈসু, মারমারা বলে সংগ্রাই এবং চাকমারা বিজু। এই তিনটি উৎসবকে একত্রে বিজু বলা হয়। এই উৎসব কেন্দ্র করে পাহাড়ে পাহাড়ে আনন্দের রং লাগে, আর গানে গানে অনুরণন হতে থাকে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। ছড়াগুলো সজ্জিত হয়ে যায় ভাসমান ফুলে ফুলে। বাংলা নববর্ষকে আনন্দ-উৎসবে বরণ করতে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সব ধর্ম-বর্ণ-শেণি-পেশার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে মঙ্গল শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় প্রদিক্ষণ করা হয় বর্ণিল মাস্ক এবং ফেস্টুন প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। রমনা বটমূল, চারুকলা প্রাঙ্গণ, জাদুঘর থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস, টিএসসি এবং শাহাবাগ চত্বর হচ্ছে এই আয়োজনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং বর্ষবরণ আমাদের একটি সর্বজনীন উৎসব। এটি একদিনের উৎসব হলেও এর রেশ থেকে যায় মাসব্যাপী। বিশেষ করে হালখাতা খোলার উৎসবসহ মাসব্যাপী বৈশাখী মেলা, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন চলতে থাকে। এই উৎসব হচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। রোজা থাকা সত্ত্বেও পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে লাখ লাখ লোকের সমাগম হবে। বৈশাখী কেনাকাটা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি চলছে ঈদের কেনাকাটা। একদিকে দেশের পর্যটন অর্থনীতির চাকা যেমন সচল হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়ন হচ্ছে। এবারের পর্যটন ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের অফার নিয় হাজির হচ্ছে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, পিকনিক স্পটসহ সব পর্যটন কেন্দ্রগুলো সাজছে উৎসবের রং মেখে।

বর্ষবরণে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষবরণসহ সব উৎসবের এবং কল্যাণের গান পরিবেশন করা হয়। আরও পরিবেশন করা হয়, কবি নজরুল ইসলামের আগুনঝরা নবচেতনার সব গান। পুরাতন ঝরাজীর্ণ সব কিছু পেছনে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শপথ হচ্ছে বাঙালি জাতির দর্শন। সব ভেদাভেদ, সংকীর্ণতা এবং কালিমা দূর করে এস.এম সুলতানের চিত্রের মতো বলীয়ান হওয়াটাই হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য। প্রযুক্তির কল্যাণে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান লাইভে পৃথিবীর সব মানুষ উপভোগ করতে পারবে।

অন্যদিকে ঈদ হচ্ছে আমাদের একটি ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মুসলমানদের অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও বাংলা নববর্ষের মতো এটা সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের স্লোগান হচ্ছে ধর্ম যার যার উৎসব সবার। সব ধর্মের নানা উৎসব বাঙালি জাতির সব লোকের উৎসব। বাঙালির এ সম্প্রীতি, মেলবন্ধনই হচ্ছে সর্বজনীন দর্শন যা বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি অন্যতম দর্শন।

বাংলা নববর্ষ এবং ঈদ দুটি বাঙালি জাতি তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য শান্তি, কল্যাণ এবং সোহার্দ্য কামনা করা হয়। বাঙালি জাতির এই দর্শন সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের। পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে এ কাজের বাস্তবায়ন সম্ভব। এজন্য বেশি বেশি বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাতে হবে আমাদের। এসব উৎসবের বর্ণনা বিদেশি পর্যটকদের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলো এই দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে পারে। বিদেশি মেহমানদের দাওয়াত দিয়ে ষোলআনা বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরা প্রয়োজন। অবশ্য বিদেশে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিট বর্ষবরণ, ঈদ এবং পূজা-পার্বণের আয়োজন করে থাকে। এই কাজে বাংলাদেশ মিশনগুলো সহায়তা দিতে পারে।

ফুলে ফুলে আর গানে গানে মেতে উঠে বাঙালি জাতি। এ উৎসব মানে আমাদের স্বপ্নমাখা বিরাট রঙিন জীবন। সোপানে উঠার দৃপ্ত পথ চলার দৃঢ় বাসনা। ঈদ হচ্ছে সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন দৃঢ় করা, সমগ্র জাতীর কল্যাণ কামনা। এ বছরে দুটি উৎসব একসঙ্গে হওয়াতে আমাদের আনন্দের সীমা নেই। দুটি উৎসবে বাঙালির প্রাণে যে উচ্ছ্বাস এবং উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে তার আবেগ-প্রভা থেকে যায় বছর জুড়ে।

বর্ষবরণ এবং ঈদ উৎসব বাঙালির সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক দারুণ প্রভাব বলয় তৈরি করে। হাজার বছরের সংস্কৃতির যে বৈশিষ্ট্য তা এসব উৎসবে চমৎকারভাবে প্রতিভাত হয়। সব বয়সি মানুষের যে সম্মিলন ঘটে, বাংলা নববর্ষে তার যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষীত হয় সব ক্ষেত্রেই। বাংলাদেশের সাহিত্যে এবং শিল্পে বাংলা নববর্ষের উৎসব দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়। দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্র্রনিক মিডিয়াগুলো বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে যা আমাদের চেতনাকে শানিত করে।

তরুণ প্রজন্মকে ভার্চুয়াল জগত এবং মুঠোফোন সংস্কৃতি থেকে বের করে এনে বাংলার জল, মাটি, আকাশ চেনানোর জন্য সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে বাংলা নববর্ষ এবং ঈদ উৎসব। এসময়ে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তরুণদের ঘুরাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা। আবার বাংলা নববর্ষ বরণ এবং বৈশাখী উৎসবের বিভিন্ন মেলা-পার্বণ আমাদের নবপ্রজন্মকে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। এতে বাঙালির ধ্রুপদী গান, শিল্প এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো টিকে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। অপরদিকে ঈদ উৎসবে বাংলাদেশের পর্যটন আকর্ষণগুলোতে ঘুরতে গেলে নতুন প্রজন্ম যেমন দেশকে চিনবে, তেমনি ব্যস্ততায় থাকায় সব বাবা-মা মানষিক প্রশান্তি লাভ করবে। দেশের পর্যটন খাত হবে সমৃদ্ধ। আশা করা যায়, এবারের বর্ষবরণ এবং ঈদ উৎসবে বাংলাদেশের পর্যটন সেক্টরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে। আসুন নববর্ষের উৎসবে ঈদ এবং ঈদের উৎসবে নববর্ষ উদযাপন বিদেশে না গিয়ে দেশে করি। দেশের টাকা দেশে রাখি। সর্বজনীন উৎসব কল্যাণকর হোক সবার জন্য।