‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ এ আহ্বানের মধ্য দিয়ে আজ সূচিত হলো নতুন বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। এই দিনটিকে ইতিহাসের ছিন্নপত্রের নৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে দেখা যায়; কিন্তু বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ ভিন্নমাত্রায় মহিমান্বিত। ষড়ঋতুর রূপবৈচিত্র্য আর রঙের খেলায় শুধু প্রকৃতিই বদলে যায় না, জনজীবনেও রূপান্তর ঘটে। এভাবে প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখ আসে রুদ্ররূপ ধারণ করে বাঙালির নবপ্রত্যয় জাগ্রত করতে। প্রতিটি বাঙালি যেন এই দিনে আগুনের পরশমণির ছোঁয়ায় নতুনভাবে উদ্দীপিত হয়। হতাশা, ব্যর্থতা ও গ্লানি উপড়ে ফেলে জীবনের জয়গান বড় হয়ে দেখা দেয়। অজস্র কণ্ঠে প্রত্যয় ব্যক্ত হয়-মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিবানে শুচি হোক ধরা। গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহে আগত বাংলা নববর্ষ বাঙালি জীবনের এক প্রেরণাদায়ক দিন। বাঙালি চেতনার আলোকবর্তিকা। আজকের খুশির এই ঝরনাধারায় আলোকিত বাংলাদেশের সম্মানিত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি রইল আমাদের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির অপত্য সম্পর্ক। বাঙালির কৃষি, সভ্যতা ও কৃষকের স্বপ্ন বুনন চলে বাংলা সনকে ঘিরেই। পহেলা বৈশাখের উৎসবে যেমন সংস্কৃতি উচ্চকিত হয়, তেমনি রাজনৈতিক চেতনা দৃঢ় হয়। আগে বাংলা নববর্ষ গ্রামবাংলায় বিপুল সমারোহে উদযাপিত হতো। মেলা ও নানারকম খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাব-নিকাশের পাট চুকিয়ে নতুন হালখাতা খোলার উৎসব করতেন। মানুষ প্রাণের তাগিদে এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। বাস্তবতা হলো, এখন বৈশাখী উৎসবের সেই আদি আমেজ নেই; তাই বলে একেবারে মøান হয়ে গেছে, তাও বলা যাবে না। গ্রাম তো বটে; এখন শহরেও ধুমধামের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। নববর্ষ উদযাপনে প্রচলিত ঐতিহ্যের বেশ আধুনিক অনুষঙ্গও যুক্ত হয়েছে। প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা এরই মধ্যে ইউনেস্কোর বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশ্বায়নের যুগ হলেও বর্তমানে প্রতিটি দেশ ও জাতি তাদের ঐতিহ্যে অনুসন্ধানে প্রয়াসী হয়েছে। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, একটি জনগোষ্ঠী শেষাবধি তার নিজ ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে ক্ষত সৃষ্টি হলে প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও উন্মুল হয়েই থাকতে হয়। স্বভাবতই আমাদের ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি ব্যবহারিক জীবনের চর্চার বিষয় করে তোলা জরুরি।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বসবাস করেন। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু পহেলা বৈশাখের আনন্দ উৎসব সবার। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এ উৎসবে আনন্দচিত্তে শামিল হতে পারে। এদিন সব বাঙালির আত্মপরিচয় উপলব্ধির দিন, শেকড় সন্ধানের দিন। ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ উপড়ে ফেলে এদিন সব মানুষ একই সত্তায় যেন একাকার হয়ে ওঠে। এটাই বাংলা নববর্ষের বড় প্রাপ্তি, মানবীয় শিক্ষা। নববর্ষ মানে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐকতান। এদিনে ক্লেদ, গ্লানি, জীর্ণশীর্ণ-বিদীর্ণ, পুরোনো জরাগ্রস্ত সব বৈশাখের রুদ্রদ্রোহে পরিত্যাজ্য হোক। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।