ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আাগুনে পোড়া মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী ঢাকা
আাগুনে পোড়া মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই

কিছুকাল আগে আমার বাসায় একজন মানুষ সাহায্যের প্রত্যাশায় প্রায়ই আসতেন। তিনি আসতেন হামাগুঁড়ি দিয়ে অনেকটা শিশুর মতো, হাতে-পায়ে ভর করে। বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। তবে পোড়া বেগুনের মতো কুঁচকে যাওয়া দেহ দেখে মনে হতো অশীতিপর বৃদ্ধ। তিনি খেটে খাওয়া মানুষ এক সময় কাজ করতেন একটি জুতা তৈরির কারখানায়। জুতার শোলে আঠা লাগানো ছিল তার দায়িত্ব। সেই কাজ করার সময় একদিন কারখানার দাহ্য পদার্থে আগুন লাগলে তিনি অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। তার শরীরের নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। ঠিকভাবে দাঁড়ানো দূরে থাক বসাও তার জন্য অসাধ্য হয়ে পড়ে। হাসপাতালে বিনামূল্যে সম্ভাব্য চিকিৎসা গ্রহণের পর তার জীবন বেঁচে গেলেও তিনি হারান কর্মক্ষমতা। বর্তমানে দেশে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরে বন্দরে প্রায় সর্বত্র সিএনজি গ্যাসচালিত যানবাহন চালু হওয়ায় বাড়ছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা প্রকাশ করার মতো নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ পুরোনো সিলিন্ডারের এককটি যেন চলমান বোমা। এর বিস্ফোরণ যানচালক এবং যাত্রীর জীবননাশের কারণ হতে পারে যেকোনো সময়ে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের করুণ পরিণতি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্ট, রাসায়নিক কারখানাসহ নানা স্থানে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ মানুষ হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা নিতে। এ সংখ্যা বছরে প্রায় ৬ লাখ। পুরান ঢাকার নিমতলি, লালবাগের মতো এলাকার রাসায়নিক গুদামের অগ্নিকাণ্ডে এতো মানুষের মৃত্যু আজও জাতিকে কাঁদায়। বেশ কিছুকাল আগে রাজনৈতিক সহিংসতার রেশ ধরে দেশে অবরোধ ও হরতালের সুযোগে চলছে চরম নৈরাজ্য, সহিংসতা। পেট্রলবোমা আর ককটেলের আগুনে পুড়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে অনেকের। আহত হয়েছেন নিরীহ শ্রমজীবী মানুষ। এদের বেশির ভাগ বাসযাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিক বা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। রয়েছে নারী ও অবুঝ শিশুও। চিকিৎসকদের মতে শরীরের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পুড়ে গেলে জীবন শঙ্কাটাপন্ন হয়ে পড়ে। তারচেয়ে বড় কথা পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধ মানুষের বেশির ভাগেরই কণ্ঠনালী পুড়ে যায়। কেননা, বাস কিংবা সিএনজি অটোরিকশায় আগুন লাগলে সংকীর্ণ পথে অনেক মানুষের বেরুতে সময় লাগে এবং এর মধ্যেই তাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে পেট্রলের বিষাক্ত আগুনের হলকা কণ্ঠনালীতে ঢুকে যায়। তা ছাড়া অগ্নিদগ্ধদের শরীরে সঙ্গে সঙ্গে পানি ঢালার কোনো সুযোগ না থাকায় শরীরের বিভিন্ন অংশও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই তাদের সম্ভাব্য সুচিকিৎসা দিয়েও অনেক সময় জীবন রক্ষা সম্ভব হয় না।

অগ্নিদগ্ধ বেশির ভাগেরই স্থান হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। ১৯৮৬ সালে মাত্র ৬টি শয্যার বার্ন ইউনিট ২০০৩ সালে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০-এ। ৫০০ শয্যা সংখ্যার শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ২০১৯ সালের ৪ জুলাই কাজ শুরু করায় দেশে অগ্নিদগ্ধ মানুষের সুচিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এখানে রয়েছে ২২টি আইসিইউ বেড, ২২টি এইচডিইউ সুবিধাসহ ১২টি অপারেশন থিয়েটার। ২০১৯ সালের ডেঙ্গু এবং ২০২০ সালের করোনা অতিমারির সময়ে এ হাসপাতালকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বর্ধিত অংশ হিসাবে ব্যবহার করে রোগাক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। বিশেষজ্ঞের মতে, শরীরের চামড়ার বিভিন্ন স্তর থাকে। পেট্রল বোমাসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের আগুনে পোড়া মানুষের ক্ষত চামড়ার অনেক গভীর স্তরে পৌঁছে যায় যা শুকাতে সময় লাগে অনেকদিন। এ ধরনের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। এছাড়া বাংলাদেশের হাসপাতালের অনেক সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। বিপুল সংখ্যক অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিৎসা প্রদানের জন্য হাসপাতালের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম। রয়েছে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব। ট্রেনিংপ্রাপ্ত নার্সের সংখ্যাও অপ্রতুল। ঢামেক, সোহরাওয়ার্দী, মিডফোর্ড হাসপাতাল ছাড়া অগ্নিদগ্ধদের সুচিকিৎসা দেয়ার তেমন সুব্যবস্থা নেই। বর্তমানে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সীমিত পর্যায়ে বার্ন ইউনিট খোলা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দাহ্য পদার্থে অগ্নিদগ্ধ মানুষের পোড়া ঘা শুকাতে যেমন সময় লাগে অনেক তেমনি এদের মাঝে দেখা দেয় নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়। এমনকি পোড়া দেহ নিয়ে অনেকে জীবনে বেঁচে গেলেও তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন না। অনেকে হয়ে পড়েন পঙ্গু। কারও বুকের চামড়ার সঙ্গে দুই বাহুর চামড়া লেগে যায়। শরীরের নিম্নাঙ্গ পোড়া মানুষ তো আর ১০ জনের মতো হাঁটতে চলতেও পারেন না। এসব নিরাময়ের জন্য অনেক সময় প্রয়োজন পড়ে ব্যয়বহুল প্লাস্টিক সার্জারি যা নিম্নবিত্তদের পক্ষে বেশির ভাগ সময় সংকুলান সম্ভব হয় না। কাজেই তাদের জন্য স্বাভাবিক কাজকর্ম সম্পাদন, আয় রোজগারের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর সক্ষমতা ফিরে পেলেও তাদের ফেলে আসা কর্মস্থলে নতুন লোক নিয়োগের ফলে তারা হয়ে পড়েন কর্মহীন। পরিবার-পরিজন নিয়ে হয়ে পড়েন দিশেহারা। কালক্রমে দেখা দেয় মানসিক বৈকল্য। এদের বেশির ভাগই অনিদ্রাজনিত সমস্যায় ভোগেন যা থেকে দেখা দেয় ভিন্নতর নানা সমস্যা। এরা অল্প শব্দেই চমকে ওঠেন, হয়ে পড়েন নার্ভাস। অগ্নিদগ্ধ মানুষের মনে সব সময় একটা আতঙ্ক কাজ করে, অল্পতেই ভীত হয়ে পড়েন। আবার বোধহয় আগুন লাগল, পুড়ে গেল শরীর এমন এক শঙ্কা মনকে চেপে রাখে সর্বদা। তাই তারা জীবন সম্বন্ধে হয়ে পড়েন হতাশাগ্রস্ত। শুধু অগ্নিদগ্ধ রোগীই নয়, তাদের চারপাশের মানুষ, আত্মীয়স্বজন, সেবাদানকারী চিকিৎসক-নার্স, দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকারী মানুষজনও মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেক সময় রোগীকে সাহস জোগাতে জীবনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গিয়েও তারা মর্ম-যাতনায় ভোগেন। এমনকি রাস্তাঘাটে যারা যানবাহনে আগুন লেগে মানুষকে অগ্নিদগ্ধ হতে দেখেন তাদের মনেও এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রোগীর আত্মীয়স্বজনের ক্ষতির পরিমাণ কল্পনাতীত। রোগীর পাশে থেকে দিনরাত সেবাদান, ওষুধ-পথ্যের জোগান দিতে নিম্নবিত্তের এ মানুষগুলো হয়ে পড়েন অসুস্থ। এ ছাড়া অনেক সময় সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির রোজগারের পথরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাদের শারীরিক মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিৎসার পর সৌভাগ্যক্রমে যারা প্রাণে বেঁচে যান তার ভোগেন দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যায়। তারা কিছুতেই আগুন লাগা শরীর ঝলসে যাওয়ার স্মৃতি ভুলতে পারে না। বারবার বিস্ফোরিত বোমার গনগনে আগুনের জ্বলন্ত দৃশ্য মানসপটে ভেসে ওঠে। কখনও ঘুমের মাঝে তারা চিৎকার করে ওঠেন। আর বোমা ছুঁড়ে আগুন লাগানোর হীন মানসিকতা তাদের ভাবিয়ে তোলে, ভয়ানক কষ্ট দেয়। হাসপাতালের কক্ষভর্তি অগ্নিদগ্ধ অন্যান্য মানুষগুলোর কথা মনে করে তারা হয়ে পড়েন আরও দুর্বল। বিশেষ করে, হাসপাতালের বেডে চোখের সামনে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দুঃসহ স্মৃতি তারা ভুলতে পারেন না কোনো দিন। কাজেই প্রাণে বেঁচে যাওয়া পোড়া মানুষের জন্য জরুরি দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চিকিৎসা যা অনেকেরই নেওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। ঢাকার জাতীয় মাননিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এ ধরনের মানসিক রোগাক্রান্ত রোগীর সীমিত পরিসরে হলেও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষের খুব কমই এ হাসপাতালের দ্বারে আসেন। অগ্নিদগ্ধদের হাসপাতালের মানসিক চিকিৎসা ছাড়াও পারিবারিক মানসিক পরিচর্যা জরুরি হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদের ক’জনের পক্ষে তা দেয়া সম্ভব! কজন প্রতিবেশী তাদের পাশে এসে দাঁড়ান এ ধরনের সংকট মোকাবিলায়!

দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজারো অগ্নিদগ্ধ মানুষের আহাজারি, মৃত্যু, চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না। তবে অগ্নিদগ্ধ মানুষের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা প্রসারিত করা সম্ভব। এজন্য বাড়ানো দরকার হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের সংখ্যা। আধুনিক যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা উপকরণ বৃদ্ধিসহ চিকিৎসক ও নার্সদের অগ্নিদগ্ধ রোগীদের সুচিকিৎসা প্রদানে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যাবশ্যক। আরোগ্য লাভের পর অগ্নিদগ্ধ রোগীর মানসিক চিকিৎসা সেবাদানের লক্ষ্যে দেশে আরও অনেক মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল স্থাপন প্রয়োজন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে বেঁচে যাওয়া অক্ষম পঙ্গু মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি হুইল চেয়ার, চোখের দৃষ্টি হারানোদের জন্য সাদা ছড়ির মতো অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতে শুধু অগ্নিদগ্ধ অক্ষম মানুষটিই নয় তাদের পরিবার-পরিজন যেন দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পরে জীবনে বেঁচে থাকতে পারে। পঙ্গুত্বের শিকার অসহায় মানুষের পরিবারের সক্ষম, যোগ্য কাউকে কাজে বহাল করা হতে পারে একটি পরিবারের অনেকগুলো মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান মানুষের এগিয়ে আসতে হবে। দেশে বিত্তবান মানুষ ও সংস্থার তো অভাব নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত