ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাফরুল্লাহ চৌধুরী : ডাক্তার থেকে মুক্তিযোদ্ধা

শফিকুল ইসলাম খোকন, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক, [email protected]
জাফরুল্লাহ চৌধুরী : ডাক্তার থেকে মুক্তিযোদ্ধা

মানব জীবনে অনেক কিছু অনিশ্চিত হলেও মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যুর কাছে সব মানবের হার মানতেই হবে। যার ধারাবাহিকতায় প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত মানুষ মৃত্যুর কাছে হার মেনে না ফেরার দেশে চলে যান। না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়ে অনেক স্মৃতি রেখে যান এ ধরায়। এমনই একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি, অনেক ত্যাগ, অনেক অবদান। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন চিকিৎসক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী একজন মানবিক মানুষ।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসীম সাহসে সাদাকে সাদা বলতেন। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সত্যের পথে অবিচল ছিলেন। তার মৃত্যুতে জাতি দেশপ্রেমিক এক অভিভাবক হারাল। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। দেশকে ভালো বাসতেন, দেশের মাটিকে ধারণ করতেন বুকে, তাইতো এ ভূখণ্ডকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে ১৯৭১ সনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ফেলে বিলেত থেকে দেশে এসে অস্ত্র হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে জাফরুল্লাহ বলেছিলেন- ‘যুদ্ধ ক্ষেত্রের যে সম্পর্কটা হয়, এটা রক্তের সম্পর্কের মতো অত্যন্ত দৃঢ় হয়। সুতরাং তার সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, তার অজান্তেই আমরা জড়িয়ে পড়ি একে অপরের জন্য।’ জাফরুল্লাহ আরেকটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটি শাট ৩০ বছর ধরে পড়ছি। পড়নে একটি ছিড়া প্যান্ট নিয়ে তিনি বলেছিলেন, প্যান্ট ছিড়লে কি করব? তালি দিয়েই তো পড়তে হবে। ফেলে দিলে কি হবে? দেশের অনেক মানুষ তো খালি পায়েও হাঁটে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেখেছি মানুষ খালি পায়ে হাঁটে।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিলেত থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা না দিয়ে দেশের মায়ায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুক্তিকামী মানুষদের কথা বিবেচনা করে মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসাসেবার জন্য ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলেন। একটিকে অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী মানুষদের চিকিৎসাসেবাও দিয়েছিলেন। শুধু স্বাধীনতার সময়ই নয়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা খাতসহ বিভিন্ন অঙ্গনে তার রয়েছে অনেক ভূমিকা। এমন একজন মানুষের শূন্যতা বাংলাদেশে শূন্যতাই থাকবে পূরণ হওয়ার নয়।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। দশ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্র ইউনিয়নের মেডিক্যাল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন। ১৯৬৪ সালে ডিএমসি থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএমএ) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি। পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি এফআরসিএসের চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে লন্ডন থেকে ভারতে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন এবং সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসাপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় তার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। দেশের সেবায় ট্রাস্টি বোর্ড করে ১৯৭২ সালে সাভারে গড়ে তুলেছিলেন এ প্রতিষ্ঠান। নিজেকে নিয়োজিত করেন গণমানুষের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের করেছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী। প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রাখেন যুগান্তকারী ভূমিকা। ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি দেয়া ছিল বঙ্গবন্ধুর। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় সরকার। ফিলিপাইনের র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে তাকে দেয়া হয় রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড। কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে দেয় ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে থেকে ২০১০ সালে দেয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ ২০২২ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘এনআরবি লিবারেশন ওয়ার হিরো ১৯৭১’ পুরস্কার দেয়।

বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্য খাত যখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে ঠিক এমন সময় জাফরুল্লাহ স্বাস্থ্য খাতটি সেবায় হিসেবে চলমান রেখেছেন। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মোট খরচ মাত্র ২ হাজার টাকা, কিডনি ডায়ালাইসিস যেখানে খরচ হয় ৮ হাজার টাকার উপরে, সেখানে তার হাসপাতালে খরচ মাত্র আড়াই হাজার টাকা। বৈশ্বিক মহামারি করোনায়ও তার রয়েছে অনেক ভূমিকা। করোনার কিট নিয়েও ব্যপক আলোচনায় আসেন তিনি।

এই গুণী মানুষটির সঙ্গে আমার দুইবার দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

সালটি আমার মনে নেই ঢাকায় বিয়াম মিলনায়তন ও সিরডাপ মিলনায়তনে দুইটি সেমিনারে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি সেমিনারে দুপুরের খাবার এক টেবিলে বসে খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন আমি চিন্তাও করতে পারিনি এতো বড় মাপের মানুষটির সঙ্গে এক টেবিলে খাবার খাবো। খাবারের ফাঁকে তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন, জানতে চাইলে কি করছি। তার প্রশ্নে আমি ঘাবড়ে গেছিলাম। তখন আমাকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আবারও বললেন বলো? কি করছো? তখন সাংবাদিক পরিচয়টা এরিয়ে গিয়ে লেখালেখি করছি বলায় তিনি বলেন, ‘খোকন... লেখালেখি চালিয়ে যাও, গবেষণামূলক লেখা বেশি বেশি করে লিখবা, একদিন মূল্যায়ন হবে তোমার।’ তিনি নিজে এতো গুণের অধিকারী হয়েও নিজের কথা কিছু না বলেই আমাকে আরও পরামর্শ দিয়েছেন। গর্ব করে বলার মতো এ ঘটনা। এরপর আর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। এখন আর কথা হবেও না। কথাও হবে না, পরামর্শও দেবে না। ওপারে ভালো থাকবেন। আপনি শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধাই নন, একজন চিকিৎসক, একজন গবেষক, মানবতার ফেরিওয়ালা, আপনি দেশের একজন গর্ব ছিলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত