নতুন বছরে বহু পাক্ষিকতা

গৌতম কুমার রায়, গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৪৩০ বঙ্গাব্দ এলো। বছর ফিরেছে আবার। অক্ষয় আনন্দ স্বরূপে। নতুন বছরে বহু পাক্ষিকতা, যেন জাগিয়া উঠিছে প্রাণ। সময় বয়ে যায়। তবে তা বিবর্তনকে সমর্থন করে। সময় গেলে বিবর্তিত হয় পরিবার, সমাজ, প্রকৃতিও। অভিপ্রায়ণ ঘটে মানুষেরও। মহাকালের গর্ভে সময় পতিত হয়ে আবার ফেরে যে সময়, সে ফেরার আনুসঙ্গিকতা থাকে। প্রাণী তার স্বরূপকে বিসর্জন দেয়। প্রকৃতি হারায় তার ধারাকে। তবে বিসর্জন বা হারানোর মধ্যেও বছরের ফিরে আসাটা সব সময়ই আনন্দের। পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে স্বাগত জানাতে মানুষ অভ্যাসগত।

শাশ্বত বাংলা আমার। আমার নতুন বছরের মৌলিকতা হলো, গাছে গাছে নতুন পাতা, নতুন ফুল। আর মৌমাছি কিংবা ভ্রমরের মধু আহরণে আঁচড়ে পরা ভির। বাতাসের ঢিমে তালে এলোমেল চুলে কোন কিশোরির দূরন্তপনা। নদীর কূলে বটবৃক্ষের ছায়ায় হয়তো পল্লীগীতি কিংবা ভাটিয়ালি নতুবা ভাওয়াইয়া, লোকগান, কীর্ত্তন, মুরর্শিদী, বাউলের একতারা বা বৈষ্ণবের আকুষ্ঠ দেহ সাধনার বৈরাগ্য সুরের অবগাহন। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দে নাউ ভাসানো যাত্রী পারাপার। নদী কোথাও উদরে জন্ম দিয়েছে ধূ-ধূ বালুচর। নদীর কোলে আশ্রিত কোথাও এতটুকু কোলে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার চিৎকার। ঝাউ বনের বিস্তৃতিতে শেয়ালের বাহাদুরি হাকডাক। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় তাপে কাপানো দাবদহ বা নদী ভাঙনে গাং শালিকের সুরম্য আশ্রয় হারিয়ে আবার খুঁজে ফেরার অনিবার্য উত্তেজনা। নতুনকে আলিঙ্গন করতে নিজেদের উপস্থাপন করা যেন আজ প্রথম, আজ শুরু। আজ বসন্ত শেষে এসেছে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়

‘...জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,

ওরে উথলি উঠেছে বারি,

ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি...।’

বছরের পর বছর হারিয়েছে। প্রকৃতির আমোঘ টানে যেমন জীবের আবর্তিত যাত্রা, তেমনই বাঙালি নববর্ষের সৃষ্টি বার্তাকে লালন-পালন করে হাজির ঠিক নতুনের মুখ্যতায় পরিবেশের এক নতুন নিমন্ত্রণে নতুন বছর। যা আমাদের পরিবার, সামাজিক, ব্যবসা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। নদীর সাথে যেমন প্লাবনভূমি, বিল, ছোট নদীর সম্পর্ক তেমনই বাঙালির সঙ্গে বর্ষবরণের রসায়ন। রেজুলেশনে শুধু নতুন সাজে প্রকৃতিকে বরণ করে নেয়া। যার অনুভূতি নিরপেক্ষ ও শাশ্বত আবেগের। আলপনার সামগ্রিকতায় জাগ্রত বিবেক নতুন রূপে রূপায়িত করে জীবনকে ক্ষণ সময়ের জন্য অনুভবে আনা। কিন্তু এ দিনের অপেক্ষা কিন্তু আদৌ অল্প সময়ের নয়। যুগে যুগে বাঙালি দিব্য জ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে লোকাচারে ধারণ করেছে তার লৌকিকতাকে। সমাজের জঞ্জাল সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিভেদ, অন্যায়, অনাচার, অভিশাপ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, জাত-পাত বিসর্জন দিয়ে সৌম্য ও সম্প্রীতির বাতাবরণে তৈরি করেছে আজকের এ নির্হংকার মৌলিক পার্বণকে। দিনে দিনে ব্যর্থতার জায়গাগুলোকে খুঁজে বের করে তা বিসর্জন দিয়ে, আবার সুখ ও সাম্যের সন্ধানে হাঁটতে হয়েছে। তারপর এসেছে আলিঙ্গন। যা বর্ষবরণের সারলৌকিক আলিঙ্গন। বাঙালির বর্ষবরণ বেশ নান্দনিক উৎসব বটে। যেন মঙ্গল প্রভাতে নতুন আলোয় আমাদের প্রকৃতি। বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখকে গ্রহণ করেছেন জীবনের লুক্কায়িত উপলব্ধি থেকে। তিনি বলেছেন,

‘চৈত্র যে যায় পত্র ঝরা,

গাছের তলায় আঁচল বিছায়

ক্লান্তি অলস বসুন্ধরা।’

আগে দেখেছি চৈত্র সংক্রান্তির মেলা হতো। চৈত্রের পর বৈশাখী মেলা জানান দিত বছর পেরিয়ে গেছে, এসেছে নতুন বছর। এ সময়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা বৈশাখী মেলা থেকে তাদের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি কিনতেন। আর উচ্চবিত্তরা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিশেষ করে হালখাতায় বাকি-বকেয়া আদায় করে আবার নতুন হিসেবে ব্যবসা শুরু করতেন। তখন শুধু বাঙালি হিন্দুরা বর্ষবরণের মেলা নিয়ে মাতামাতি করত। অন্যেরা তেমন করতেন না। দিনে দিনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান জননন্দিত হয়েছে। হয়েছে সর্বজনীনও। উৎসবে মানুষের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এখন বর্ষবরণ সব বাঙালির উৎসব হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের বেড়াজাল ছিড়ে একত্রিত হয়েছে, কাতারবন্দি হয়েছে মানুষ। ঐতিহ্যকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে বছর বরণ করতে সবাই যেন সাগ্রহ অপেক্ষায়। সরকারের স্বদিচ্ছা এই উৎসবকে আরও আলোকিত করতে সাহায্য করেছে। নতুন বছর এখন উৎসবের। বাঙালির অস্তিত্বের। এখন তা আর ধর্মীয় বিবেচনায় নেই। সরকার বৈশাখী ভাতা দিয়ে বর্ষবরণে সবার সংযুক্তিতে শক্তি জুগিয়েছে। বাংলার কলকাতাতে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার প্রথম কলকাতায়, ইরেজী নববর্ষ পালনের আদলে, বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু করেন। এখানে বেশ ঘটা করে তা উদযাপিত হয় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৫০ দশকের প্রথম দিকে আমাদের দেশে ঘটা করে বর্ষবরণ উৎযাপন করা হয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভার পূর্ব বাংলার তৎসময়ের মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক নববর্ষ উৎযাপনে ছুটি ঘোষণা করেন। সেই থেকে ঢাকা শহর কেন্দ্রিক বাংলা বর্ষবরণ পালন ঘটা করে হতে থাকে। এরপর পাকিস্তান সরকার আমাদের এই বর্ষবরণকে পালন করতে দিতে চাইতো না। তারা এ উৎসব পালনে রাজনৈতিক ভয়ের কারণ মনে বরতেন। তবে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঘটা করে বাঙালির নববর্ষ পালনে ছায়ানট বিশাল ভূমিকা রেখেছিল বলে জানা যায়। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের পর হতে ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের আগে এবং পরে বাংলা বর্ষবরণ যে আনন্দের ছিল, নিঃসন্দেহে এখন সে ধারা একটু হলেও বদলে গেছে এবং এতে এখন বাহারি রং ধরেছে। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, সেখানেই নতুনের আলোর সঙ্গে নতুন বছর পালনের এক সুঘ্রাণ পাচ্ছি। এখনও অনেক বাঙালি পহেলা বৈশাখে মাটির প্রদীপে তেলের পৈলতা জ্বালিয়ে মঙ্গল আলো ছড়িয়ে দেয়। যেন আঁধারকে দূরে ঠেলে দিয়ে আলোর পথ তৈরি করার এক অভিপ্রায়। কেউ কেউ বটবৃক্ষের তলে ঢাক পিটিয়ে জানান দেবার অপেক্ষায় বৈশাখ এলো। অনেক বাঙালি বণিকরা তাদের ব্যবসায়ে হিসাবের নতুন লাল খাতা খোলেন হালখাতার আনুষ্ঠানিতায়। শান্কি থালায় পান্তাভাতে কাঁচামরিচে ইলিশের গন্ধ, দই-চিড়ের মিষ্টি স্বাদ, পিঠা, পায়েস, পুলি এবং হরেক রকম বাঙালি খাবারের আয়োজন বর্ষবরণকে আরও বর্ণময় এবং রসময় করে তোলে। পরিবেশে বৈশাখীর তীব্রতা আর যাই হোক, উৎকণ্ঠা বাড়ালেও তা; কিন্তু উৎসবের আমেজকে নসাৎ করতে পারে না। আমরা জানি বৈশাখে ঝড়ের আতঙ্কের পরেই বৃষ্টি। অর্থাৎ প্রকৃতিতে প্রাণ চাঞ্চল্য ফেরে। প্রকৃতি সজীব ও সতেজ হবে। শক্তি পেয়ে আবার আমাদের ফুল, ফল, ফসলের ক্ষেত ভরে ওঠে। বৈশাখ মানেই আনন্দের মাত্লামি, আমরা এক কাতারে সবাই সমান। ধর্ম আমাদেরকে অসাম্প্রদায়িক করতে পারেনি। তবে বর্ষবরণের উৎসব আমাদের অসাম্প্রদায়িক করতে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে। যা কিনা আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনার বিষয়ও। বছরের পর বছর ঘুরে এই উৎসব আসে, এবারেও এসেছে। আমরা এ উৎসবকে এখন সার্বজনীন ভাবি। কেননা, নববর্ষ এখন সীমানা ছড়িয়ে সবার হয়েছে। তারুণ্যের জ্যোতিতে নববর্ষ হয়েছে বাঙালির সর্বজনীন এক জয়পত্র। যা সুখকে সমাদৃত এবং দুঃখকে সুখের পথে আপন করে নিতে শিখিয়েছে। সময়ের নতুন অধ্যায়কে জন লিডগেট বর্ণনা করে গেছেন- এইভাবে যে, ‘নতুন দিনই নতুন চাহিদা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটায়।’