মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৭ এপ্রিল ১৯৭১

হাসানুর রশীদ, বঙ্গবন্ধু গবেষক ও ঔপন্যাসিক

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে প্রত্যাশা নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, বছর না যেতেই সে প্রত্যাশায় ধস নামে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা অগ্নিজ্বলা শুরু করে। পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে অবমূল্যায়ন করে উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করার কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করে তাদের শাসন-শোষণের পরিকল্পনা করে। ফলে স্বাধীনতার নামে বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনে ইউরোপীয় সাদা চামড়ার বদলে উপমহাদেশের ধূসর-বাদমি চামড়ার শাসকদের কালযাত্রা শুরু হয়। ফলে তাদের আবার প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনমুখী হতে হয়।

একটি সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারে চক্রান্ত ও কঠোরতা অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক রাজনীতির বিকাশ ঘটে। সে রাজনৈতিক দলগুলো সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগকে অকল্পনীয়ভাবে পরাজিত করে সরকার গঠন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের ষড়যন্ত্রে সে সরকার ভেঙে পড়ে। তারপর অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতি। সে অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন শুরু হয় এবং সামরিক শাসকরা পূর্ব-পাকিস্তানের জনমানুষের প্রত্যাশাকে চক্রান্ত ও ক্ষমতা প্রদর্শন করে অবদমন করে রেখেছে। ফলে অধিদার প্রতিষ্ঠায় পূর্ব-পাকিস্তানিদের বারবার আন্দোলনে যেতে হয়েছে। ১৯৬২ ও ১৯৬৬ গলিয়ে ১৯৬৯ সালে তাদের জন-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে হয়েছে। জীবন দিয়ে ১৯৭০ সালে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিতে হয়েছে। কিন্তু সে নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত দল আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করতে হয়েছে। তারপরও তারা পছন্দের সরকার পায়নি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সামরিক সরকার নির্বাচিত আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতা না পুরোনো চক্রান্ত নতুন মাত্রায় শুরু করে। রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণের জন্য ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে ভয়ংকর জনপ্রতিরোধ দেখা দেয়। এবারও পাকিস্তান সরকার বাঙালির জনপ্রতিরোধকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেনি। মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে কেন্দ্রীয় সামরিক সরকারপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন।

এবার আসা যাক ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ও তার পরের ঘটনায়। একেবারের অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিকভাবে ভেঙে গেল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আপোস-আলোচনা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসহীনতার সর্বশেষ পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান আলোচনার গৃহীত সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে না জানিয়ে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান চলে গেলেন। সে রাতেই শুরু হলো সহস্রাব্দের ভয়ংকর গণহত্যা-অপারেশন সার্চলাইট। রাতে ঘরেফেরা মানুষরা রাস্তায়, রিকশায়, গাড়িতে লাশ হয়ে পড়ে রইল। বাসাবাড়ি, হোস্টেল-হলে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষ আর সকাল দেখতে পেল না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গোপনে ঢাকা ত্যাগ এবং সে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বঙ্গবন্ধুকে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করল যে, আর আলোচনার সুযোগ নেই। ফলে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের মধ্যপ্রহরে জাতিকে আত্মরক্ষার আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। আর তার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হলো।

২৫ মার্চের ভয়ংকর গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের ঘটনা দেশবাসীর মতো আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ভীত ও সতর্ক করে দেয়। তারা খুব দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকেন। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল করা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ধানমন্ডি থেকে ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। ৩০ মার্চ তারা মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় পৌঁছান। মেহেরপুরের তৎকালীন ডিসি তওফিক এলাহী ও ঝিনেদার এসডিপিও মাহবুবউদ্দীন তাদের কলকাতায় যেতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। সে স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন :

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌঁছলেন। রাত আনুমানিক আটটার কাছাকাছি। মি. মজুমদার জানান, তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশেই তিনি এখানে এসেছেন। আমরা আমাদের সংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সাহায্যের আবেদন জানাই। মজুমদার বলেন, আপনাদের আবেদনের জবাব শুধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীই বলতে পারেন। তিনি জানান, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।

তওফিক এলাহী ও মাহবুবকে বিদায় দিয়ে মজুমদারের জীপে চড়ে আমি ও তাজউদ্দীন ভাই কলকাতা যাত্রা শুরু করি। মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। তার এ কথা শুনে আমরা কিছুটা আশ্চর্য হই। রাতেই তার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে। আমাদের আগমনের কথা শুনেই মজুমদার দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জীপ থেকে নামিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত বড় কালো রঙয়ের একটি গাড়িতে তোলা হলো। বিমান থেকে ছয় ফুটেরও বেশি লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে উঠলেন। মজুমদার তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী। রুস্তমজী এক সময় ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর নিরাপত্তা প্রধান ছিলেন। নেহেরু পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুবই আস্থাভাজন।

ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তমজীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রবাসী সরকার পরিচালনা ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আলোচনা করেন, সহযোগিতাও চান। কিন্তু তার পক্ষে সহযোগিতা করার বিষয়ে মতামত দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে রুস্তমজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন।

১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাকে নিশ্চিত করেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র লোকদের হত্যা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের বাড়টি কথাটুকু তাকে বলতে হয়েছিল। তারপর তাজউদ্দীন আহমদ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে উপযুক্ত সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন। এ সাক্ষাৎকার সম্পর্কে মঈদুল হাসান ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে লিখছেন :

একাত্তরের ৩ এপ্রিল রাতে তাজউদ্দিন আহমেদকে ১ সফদর জং রোডের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন পৌঁছান, মিসেস গান্ধী তখন দীর্ঘ বারান্দায় হাঁটছিলেন। তাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরার প্রশ্ন ছিল, শেখ মুজিব কোথায়? উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তিনি গ্রেপ্তার হলেন কেন? তাজউদ্দিন তাকে বলেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সরকার গঠন করেছেন, তারপর একটা বিভ্রাটে পড়ে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার এই কথায় ইন্দিরা গান্ধীর সংশয় কাটেনি।

পরবর্তীকালে তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় ফিরে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু সে সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কে কোথায় আছেন, সে বিষয়টি তার জানা ছিল না। ফলে তিনি কিছুটা সময় নিতে চাচ্ছিলেন। এ সময় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাকে অতিদ্রুত অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠনের জন্য বলতে থাকেন। সে সময় একটি সরকার গঠনের জটিলতার দিকটি বিবেচনা করে তাজউদ্দীন আহমেদ তাকে বলেন :

আপনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জানেন না, সরকার গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝি; কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন করে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি)

প্রকৃত অর্থেই পরবর্তীকালে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সামনে চলে আসে। অবশ্য অল্পসময়ের মধ্যে প্রবাসী সরকার গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য কমিয়ে আনেন। অবশেষে প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার এবং টেলিযোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন ও প্রশাসন মন্ত্রণালয় নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী, এম মনসুর আলীকে অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহণ বিষয়ক মন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষিবিষয়ক মন্ত্রী করে বাংলাদেশ অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করেন। তারপর তাজউদ্দিন আহমদ সরকার গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১০ এপ্রিল তার রেকর্ডকৃত ভাষণ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেভাবেই তার ভাষণ রেকর্ডপূর্বক সম্প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সে ভাষণ প্রচার করার বিষয়ে বেশ কয়েকজন তরুণ নেতা আপত্তি করেন। শেখ ফজলুল হক মণিও প্রবল আপত্তি করেন এবং তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে সে ভাষণ প্রচার না করার জন্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। তিনি জানান, তারা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারও প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। ফলে তাজউদ্দীন আহমদ সে সময় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে তাঁর বক্তব্য প্রচার সাময়িকভাবে স্থগিত করার কথা বলেন। এ বিষয়টি সম্পর্কে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখছেন :

গোলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে, আজ বক্তৃতা প্রচার করা যাবে না। এ কথা শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিলম্ব করা ঠিক হবে ? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব কিছু ঠিকঠাক সে মুহূর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে, তা আমরা ভেবে দেখছি কিনা। এরই মধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌঁছে গেছে।

গোলক মজুমদারের প্রস্তুতি কথা শুনে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নিজ সিদ্ধান্তে ভাষণটি প্রচার করে দিতে বলেন। ১০ এপ্রিলের ভাষণ প্রচার নিয়ে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য থাকলেও এই ভাষণটি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বিপুল ভূমিকা রাখে। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের এক আবেগময়ী, ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্য শক্তি সঞ্চার করে। আবার ২৫ মার্চ কালরাত্রের পর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ নিজের মতো করে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। অনেকে করণীয় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আবার কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা চট্টগ্রামে সম্মুখ যুদ্ধের পর সিলেটের তেলিয়াবাড়ি চা-বাগানের ডাক-বাংলোয় অবস্থান করছিলেন। তারাও দিকনির্দেশনা লাভ করেন। মূলত এ ভাষণকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি কলকাতায় এসে জড় হয়। এই ভাষণকে কেন্দ্র করে ১৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকারপ্রধান করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।

এদিন মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামের এক আমবাগানে বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তবে তখন তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জান্তিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে এ সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রদীপ্ত এক দিন।