ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ক্লাস ওয়ান-টু-থ্রি : পরীক্ষা হওয়া না হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক

বোরহান বিশ্বাস, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
ক্লাস ওয়ান-টু-থ্রি : পরীক্ষা হওয়া না হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক

কিছুদিন আগে একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, স্কুলের সামনে বেশ জটলা। কাছে গিয়ে দেখলাম- আড়াই মাস বন্ধের একটি নোটিশ লাগানো হয়েছে স্কুল গেটে। সেটি দেখতেই অভিভাবকরা ভিড় করেছেন। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মুখে মুখে আলোচনা। স্কুল খুলেই অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা!

ক্লাস ওয়ানের দু’জন অভিভাবক পরস্পরের সঙ্গে কথা বিনিময় করছিলেন। কিছু কথা কানে এলো। একজন অভিভাবক বলছিলেন, জানুয়ারিতে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মিলাদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান শেষে ফেব্রুয়ারিতে পুরোপুরি ক্লাস শুরুর পর ১ মাস চলল। কয়েকদিন আগে শ্রেণি পরীক্ষা হলো। এখন আড়াই মাসের (রমজান ও এসএসসি পরীক্ষাসহ) লম্বা ছুটি। স্কুল খুলেই জুনের প্রথম সপ্তাহে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা। সিলেবাসের কোনো খবর নেই। বাচ্চাকে কি পড়াব, বুঝতে পারছি না। অন্য অভিভাবক জানালেন, তিনি স্কুলের একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই শিক্ষক তাকে জানিয়েছেন, ক্লাস টু এবং থ্রির সিলেবাস আগেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। ওয়ানেরও সিলেবাস দিয়ে দেয়া হবে। তবে, পরীক্ষা হবে কিনা সেটা ঠিক বলা যাচ্ছে না। সরকার থেকে পরীক্ষার বিষয়ে এখনও কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত তারা পাননি। প্রথম অভিভাবক আক্ষেপ নিয়ে বললেন, নতুন সংস্করণে বইয়ের পাঠদান পদ্ধতির অনেক কিছুই তার কাছে বোধগম্য নয়। তাই ঠিক করেছেন বাচ্চাকে স্কুল শিক্ষকের কোচিংয়ে দিয়ে দেবেন। দ্বিতীয় অভিভাবক জানালেন, তিনি ভর্তির পরপরই সন্তানকে কোচিংয়ে দিয়েছেন। দুই ঘণ্টার স্কুল শেষে দুই ঘণ্টার জন্য বাচ্চাকে কোচিং ক্লাসে ঢুকিয়ে দেন। মোট চার ঘণ্টা। এই পুরো সময়টাই তিনি বাইরে বসে নানা কায়দায় কাটান। বাসা থেকে বের হন সকাল ৭টায়। ফেরেন দুপুর সাড়ে ১২টায়। এ পর্যন্তই তাদের আলোচনা শোনা গেল।

পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, বন্ধের মধ্যেই অভিভাবকদের মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে স্কুল থেকে সিলেবাস সংগ্রহের কথা জানানো হয়। তিন পৃষ্ঠার সেই সিলেবাসটি হাতে নিয়ে দেখলাম, তাতে অর্ধবার্ষিকী ও বার্ষিক পরীক্ষার জন্য প্রশ্নের ধারা ও নম্বর বণ্টন দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, কোন প্রশ্নে কত নম্বর, সেটা উল্লেখ করা হয়েছে। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৮০ নম্বর লিখিত। বাকি ২০ নম্বর শ্রেণি পরীক্ষা। ৮০ নম্বরে পাস নম্বর ৩২। খটকা লাগলো ইংরেজী প্রশ্নের ধারা দেখে। মনে হলো, ক্লাস ওয়ানেই যেন তারা ইংরেজী ভাষার অনেক কিছু শিশুদের আত্মস্থ করাতে চান। যেমন- বাক্য রচনা, এলোমেলো বর্ণ সাজিয়ে শব্দ গঠন, গ্রামার ইত্যাদি। ‘ইংরেজী থেকে বাংলা অনুবাদ’ এবং ‘বাংলা থেকে ইংরেজী অনুবাদ’- এমন ধারা দেখে অবাক হতেই হয়। পরীক্ষার এমন ব্যবস্থা কোমলমতি শিশুদের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তা বলাবাহুল্য। এ প্রক্রিয়ায় মনে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়ে পরবর্তী সময় তারা ইংরেজী শেখার প্রতি আগ্রহও হারিয়ে ফেলতে পারে। সরকার নির্ধারিত ক্লাস ওয়ানের অংক বইতে শুধুই যোগ-বিয়োগ দেয়া আছে। কোনো গুন এবং নামতা না থাকলেও স্কুল সিলেবাসে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষায় ১ থেকে ৮ এর ঘরের নামতা এবং বার্ষিকীতে ৯ থেকে ১২ ঘরের নামতা শিখতে বলা হয়েছে। এসবই হয়েছে মূলত স্কুলের জন্য পরীক্ষা নেয়া বা না নেয়ার কোনো গাইড লাইন না থাকায়।

তবে, এক্ষেত্রে রাজধানীর মতিঝিল মডেল হাই স্কুল যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করছে বলে মনে হলো। ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র মাজিদ। তার মা মাবিয়া সুলতানার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্কুলটিতে চলতি বছর ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। তাই, পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে স্কুলের সিদ্ধান্ত জানা থাকায় অভিভাবকরাও অনেকটা উদ্বিগ্নহীন। মাবিরা জানান, স্কুল থেকে বলে দেয়া হয়েছে- সন্তানকে নিয়মিত স্কুলে যেতে হবে, ডায়েরি মেইটেন করতে হবে। ক্লাসে শিক্ষকরা যা পড়াবেন তা থেকেই নামমাত্র পরীক্ষা নেয়া হবে, যা নিয়ে শিশু এবং অভিভাবকদের মোটেও উৎকণ্ঠায় থাকতে হবে না। পরীক্ষা না থাকায় অনেকেই সন্তানদের আর কোচিংয়ে দিচ্ছেন না বলেও জানালেন মাবিয়া।

প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না থাকার বিষয়টি গত বছরই সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক চলতি ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা। তবে, পরীক্ষা নেয়ার পরিবর্তে নতুন নিয়মে মূল্যায়ন করা কথা খুদে শিক্ষার্থীদের। মূলত পরীক্ষা ভীতি দূর করতে এবং পাঠদানে আনন্দ বাড়াতেই সরকার এ উদ্যোগ নেয়।

পরীক্ষা না নিয়ে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিয়ে ‘সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে’ শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা- এমনটাই সিদ্ধান্ত হয়। সাময়িক পরীক্ষার পরিবর্তে ৪ মাস পরপর বছরে তিনবার শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি প্রতিবেদন নামে একটি ‘রিপোর্ট কার্ড’ দেয়ার কথা রয়েছে। এতে শিক্ষার্থীর অবস্থা অনুযায়ী ‘সন্তোষজনক, উত্তম ও অতিউত্তম’ লেখা থাকবে।

বর্তমান পদ্ধতিতে বছরে তিনবার (প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক বা অর্ধবার্ষিক এবং বার্ষিক) পরীক্ষা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। সিদ্ধান্ত হয়- নতুন পদ্ধতিতে এসবের কিছুই থাকবে না, স্কুলেই হবে সব পড়াশোনা। একজন শিক্ষার্থী স্কুলে এসে কী করে, কীভাবে হাঁটাচলা করে, পড়াশোনা করে, শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলে, খেলাধুলা কিংবা অন্যান্য বিষয়ে ওই শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ কেমন- তার সবই মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। অর্থাৎ, স্কুলে শিক্ষার্থীর প্রতি মুহূর্তের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। একেই ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা সক্রিয় শিখন পদ্ধতির মূল্যায়ন বলা হচ্ছে। এ মূল্যায়নের জন্য পাঠ্যবইও পরিবর্তন করা হয়েছে এ বছর থেকে।

এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাথমিক শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানিয়েছেন, নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে পড়ালেখার ধারা ও মূল্যায়নে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ভীতি থেকেও মুক্ত হবে।

তিনি বলেন, নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি নিয়ে ৪ মাস পরপর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলবেন শিক্ষকরা। ওই সময়ই অভিভাবকদের জানাতে হবে শিক্ষার্থীর কোথায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে। এজন্য শিক্ষকদের যা যা কৌশল নিতে হবে তাও শিক্ষক গাইডে বলে দেয়া হবে।

এ বিষয়ে গত বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করাসহ তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না থাকার কথা বলা হয়। ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি নিরূপণ করা কথা বলা হয়।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এ রূপরেখার খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হলে সেদিনই তিনি নীতিগত অনুমোদন দেন। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ আইনগত ভিত্তি পায়।

সবকিছুই ঠিক মতো চলছে। জানুয়ারিতে ভর্তির পর পাঠ্যবই পৌঁছে গেছে শিক্ষার্থীদের হাতে। কিন্তু যে পাঠদান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ভয় থাকবে না- সেটি এখনও পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি অনেক স্কুলে। আসেনি কোনো দিকনির্দেশনাও। অনেকটা অন্ধকারেই হাঁটছেন ওইসব স্কুলের শিক্ষকরা। স্বল্প সময়ের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না এলে পরীক্ষার ভীতি আর ব্যাগভর্তি বই নিয়ে স্কুলে উপস্থিত হতে হবে খুদে শিক্ষার্থীদের। আর প্রিয় সন্তানের জীবনের শুরুতেই তাকে ঘিরে অভিভাবকের উৎকণ্ঠা বাড়তেই থাকবে। সরকার শিশুদের পরীক্ষা ভীতি দূর করে আনন্দের সঙ্গে পাঠদানে নতুন কারিকুলাম তৈরি করেছে। তবে, তার প্রায়োগিক বিষয়টি ভালো না হলে সব আয়োজনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যা কারও কাম্য নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত