চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আব্দুল জব্বারের বলী খেলা। বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ এ বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলাকে সামনে রেখে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বিরাজ করে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা গাঁও-গ্রামে বলী খেলা গরুর লড়াই, ঘোড়দৌড়সহ বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এসব মেলাতে এ অঞ্চলের মানুষের গৃহস্থলির নানা ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য আনা হতো। বছরব্যাপী এ পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো নানাজাতের গৃহস্থলির জিনিসপত্র তৈরি করত। সারা দেশের লালদীঘির বলী খেলার সাদৃশ্যে লোকসংস্কৃতির মেলা জেলা-উপজেলার ও গাঁও-গ্রামে তিন দিন চার দিন এক সপ্তাহের জন্য বসত। সেই লোকসংস্কৃতি ও খেলাগুলো স্থানীয় জনগণ নানাজাতের ধর্ম গোত্র পেশার মানুষ উপভোগ করত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি এসব মেলাতে একাকার হয়ে আনন্দের সঙ্গে সংস্কৃতির নানা আয়োজন উপভোগ করে আসছে। বৃহদাকারে চট্টগ্রামের লালদীঘির আব্দুল জব্বারের এ বলী খেলা।
তবে করোনার কারণে ২০২০-২১ বলী খেলাটি আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এবারের বলী খেলা আয়োজনের জন্য এরই মধ্যে স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি সব প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা যায়। মুসলমানদের রমজান, ঈদ এবং বৈশাখী মেলা এবারে একত্রিত হয়ে গেল। তবুও বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলী খেলা এবার লালদিঘি মাঠেই অনুষ্ঠিত হওয়ার সংবাদে স্থানীয় সংস্কৃতিমনা মানুষের মধ্যে স্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বলীর রাজ্য হিসেবে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম’। জব্বারের বলী খেলা সেই নামেরই প্রমাণ বহন করে চলেছে আজও। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলী বলা হয়। জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা এ জেলার লালদীঘি ময়দানে প্রতি বছর ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় ‘বলী’।
জব্বারের বলী খেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামি-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। এ প্রতিযোগিতার শুরু ১৯০৯ সালে, যা আজও চলছে। বলী খেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘি ময়দানের আশপাশে প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হতো। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী ও লোকসংস্কৃতি মেলা।
মধ্যযুগে সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি নিতেন, তাদের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তারা কুস্তি করতেন। সেখান থেকেই কুস্তি খেলার শুরু। কিন্তু আবদুল জব্বারের বলী খেলার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? কীভাবে এই প্রতিযোগিতার স্থান করে নিয়েছিল সারা দেশের মানুষের মনে? সেসব ইতিবৃত্ত নিয়ে আজকের লেখা।
১৯০৯ সালে প্রথম এ প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা ‘জব্বারের বলী খেলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এ দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলী খেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
খেলাটা কিছুটা প্রচলন হওয়ার পর আশপাশের বলীরা সেই সময় মাস দুয়েক আগে এসে লালদীঘি ময়দানে জড়ো হতেন। জব্বার মিয়ার বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন তারা। সেখানেই তারা খাওয়া-দাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন।
ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের নানা এলাকার বলী বা কুস্তিগীররা এ প্রতিযোগিতায় আসতে শুরু করেন। এক সময় চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা-নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ নানা জায়গা থেকেও বলীরা আসত। এরপর সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করে কুস্তিবীররা। এমনকি একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করার ইতিহাস আছে।
সত্তরের দশক থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশের বলীরা আসতে থাকে। যখন প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার শুরু হয় তখনই এর সম্পর্কে সবাই আরও ভালোভাবে জানতে পারেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই প্রথম এর সম্প্রচার করেছিল। এরপর এখন সব টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করছে। আর গণমাধ্যমের আগ্রহের কারণে জব্বারের বলী খেলা সম্পর্কে আরও প্রচার বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশে ব্যাপক মিডিয়ার প্রচার-প্রসার হয়েছে। ফলে আব্দুল জব্বারের বলী খেলা বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে লাইভ সম্প্রচার হয়। জব্বারের বলী খেলা বাংলাদেশি মানুষের যেখানেই-যেদেশেই বসবাস তারা আগ্রহের সঙ্গে খেলা উপভোগ এবং খবরাখবর রাখার অপেক্ষায় থাকে। সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে খেলাটি সুসম্পন্ন হোক স্থানীয় প্রশাসন জনপ্রতিনিধি এবং সংস্কৃতি মনা মানুষের প্রত্যাশা।