ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদ প্রস্তুতিতে খাদ্যাভ্যাসকে স্মরণে রাখুন

ডা. ইব্রাহিম মাসুম বিল্লাহ, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফরাজী হাসপাতাল, বারিধারা, ঢাকা
ঈদ প্রস্তুতিতে খাদ্যাভ্যাসকে স্মরণে রাখুন

দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। দীর্ঘ ৩০ দিনের সিয়াম সাধনার পর ঈদ নিয়ে আসে আমাদের জন্য আনন্দের বার্তা। বাঙালির ঈদ মানেই বাহারি পোশাকের আচ্ছাদন ও মুখরোচক খাবারের আদীপ্ত মন্থন। ঈদ উপলক্ষ্যে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার পরিবারেই হয়ে থাকে হরেক পদের মুখরোচক খাবারের আয়োজন। এক মাসের খাদ্যাভ্যাস বদলে এ-দিনই সকালে সবাই নাস্তার টেবিলে বসে পড়েন; মুখে পুরেন সেমাই, পায়েস, জর্দা, পোলাও, কোর্মাসহ আরো কত টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদু খাদ্য। ঘরে-ঘরে আয়োজন থাকে বলে খাওয়া-দাওয়া হয় জম্পেশ করে। কিন্তু দীর্ঘদিনের উপবাস-অভ্যাস থেকে এক লাফে অতিভোজনে স্থানান্তরিত হওয়াটা একটু চ্যালেঞ্জের ব্যাপার বটে। তাই লক্ষ করা দরকার খাবারের প্রতিক্রিয়ার দিকে, বিশেষত খেয়াল করার দরকার খাবারের পরিমাণের দিকে। এক মাস সংযমে ছিলাম বলে ৩০ দিনের খাবার একদিনে খেয়ে উদপূর্তির প্রবণতাকে দমানো প্রয়োজন। টক-ঝাল-মিষ্টি যা-ই খাই না কেন, তা অবশ্যই হতে হবে পরিমিত।

এবারের ঈদ যেহেতু বৈশাখের তীব্র তাপদাহের সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাই বেশি পরিমাণে তরল খাবারই আমাদের গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যিক। খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে সহজে হজম-উপযোগী খাবার। একসঙ্গে অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার হজমে ব্যাঘাত তৈরি করে, বুকের জ্বালাপোড়া বাড়ায়, পেট ফাপায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সৃষ্টি করে।

ইদের দিনের খাবারদাবার নিয়ে আগে থেকেই মোটামুটি একটা পরিকল্পনা থাকা দরকার। দিনের মূল খাবার অর্থাৎ দুপুর ও রাতের খাবার কোথায় খাবেন, তা ঠিক করে ফেলুন। কারও বাসায় বেড়াতে গিয়ে যথাসম্ভব কম খান। পানি, শরবত, ফলের রস ও অন্য তরল খাবার বেশি করে গ্রহণ করুন, এতে গুরুপাক খাবারের জন্য পেটে স্থান কমে যাবে।

খাবারের মেন্যুতে স্বাভাবিকভাবেই মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি থাকে। এ ছাড়া পোলাও, মুরগি, গরু বা খাসির মাংস, কাবাব ইত্যাদির সঙ্গে ঝাল খাবারও থাকে। আরও আছে চটপটি, দইবড়া কিংবা বোরহানির মতো টক খাবারও। যাদের বয়স কম এবং শারীরিক কোনো সমস্যা নেই, তারা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন এবং তাদের হজমেরও কোনো সমস্যা হয় না, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো। তবে অনেকে এক মাসের অনভ্যাসের কারণে হঠাৎ খুব বেশি ঝাল বা তৈলাক্ত বা ভাজাপোড়া খেলে অসুস্থবোধ করতে পারেন। তাই সবার জন্যই খাবার হওয়া উচিত কম মসলাযুক্ত, তৈলাক্তহীন, ভালোভাবে রন্ধিত।

যারা মাঝবয়সি বা বয়োবৃদ্ধ অথবা যাদের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে; যেমন- ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেশার বা হৃদরোগ ইত্যাদি, তাদের খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। ডায়াবেটিসের রোগীকে অবশ্যই মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং টক খাবারের মাধ্যমে রসনা ক্ষান্ত করতে পারেন। সবজি বা টক ফল দিয়ে মজাদার খাবার আগেই বানিয়ে রাখুন, এগুলো আপনাকে অন্য খাবার থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে। নেহায়েত মিষ্টি খেতে চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নেবেন। পোলাও-বিরিয়ানি কম খাবেন, ভাত খাওয়াই ভালো। তাই বলে অতিরিক্ত খাবার অবশ্যই পরিহার করবেন। মুরগি বা গরুর মাংস খাওয়া যাবে যদি অতিরিক্ত তেল বা চর্বি না থাকে। সঙ্গে কিডনির সমস্যা থাকলে মাংস পরিহার করাই ভালো। খাসি, কলিজা, মগজ, চিংড়ি ইত্যাদি খাবেন না। খাবারের পরিমাণটা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড়ো কথা এসব খাবার একবেলায় খাওয়া উচিত, অন্য বেলায় স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এই দিন একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, প্রয়োজনে ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের মাত্রা একটু বাড়াতে হতে পারে। এ ব্যাপারে ইদের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

যাদের রক্তে কলেস্টেরল বেশি বা উচ্চ রক্তচাপ আছে, অথবা হার্টের সমস্যা আছে অথবা যারা মুটিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অবশ্যই তেল ও চর্বি এড়িয়ে যেতে হবে। তবে চর্বি ছাড়া গরুর মাংস খাওয়া যাবে পরিমাণ মতো। ভাজাপোড়া খাবেন না, বিশেষত ঘরের বাইরে। আগের দিনের বাসি মাংস জ্বাল দিয়ে খাবেন না। মিষ্টিও পরিমাণের বেশি খাওয়া যাবে না। পোলাও কম খাবেন, ভাত হলেই ভালো। ফল, ফলের রস, সালাদ ইত্যাদি বেশি করে খাবেন। বিশেষ করে খাবারের শুরুতে সালাদ খেলে অন্য খাবারের জন্য জায়গা কমে যাবে। এ ছাড়া টক দই খেলে উপকার পাবেন।

কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন- মাছ-মাংস, অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে- দিনে দুই টুকরোর বেশি নয়। ফল খাওয়ার ব্যাপারেও যাদের নিষেধাজ্ঞা থাকে, তাদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া উচিত ঈদের আগেই। যারা দুধ সহ্য করতে পারেন না, তাদের দুগ্ধজজাত খাবার এড়ানো ছাড়া উপায় নেই, তবে বোরহানি বা টক দই খাওয়া যায়। অনেকে সালাদ খেলে সমস্যায় পড়েন, তাদেরও তা এড়াতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে যাতে কোষ্ঠকাঠিন্য না হয়।

ইদে অতিরিক্ত খেয়ে পেট জ্বালা করা, ফাঁপা আর পেপটিক আলসার খুব সাধারণ সমস্যা। যাদের পেটের এই সমস্যা আছে তারা অতিরিক্ত ঝাল, মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করবেন। দুই বেলা খাবার আধঘণ্টা আগে আলসারের ওষুধ, যেমন- ওমেপ্রাজল, ইসমিপ্রাজল, রেনিটিডিন ইত্যাদি খেয়ে নিবেন। প্রয়োজনে খাবার পর দুই চামচ এন্টাসিড খেতে পারেন। পেট ভরে খাবেন না, গোগ্রাসে না খেয়ে সময় নিয়ে চিবিয়ে খাবেন, খাবার সঙ্গে সঙ্গে পানি না খেয়ে একটু পরে খাবেন, রাতে খাবার পর পরই ঘুমোতে যাবেন না, কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করতে পারেন, দুই তিন ঘণ্টা পর ঘুমোবেন।

ইদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। একে রোজায় পানি কম খাওয়া হয়, সবজি কম খাওয়া হয়, ভাজা-পোড়া খাওয়া হয় বেশি। ঈদেও সেই ধারা বজায় থাকে, উপরন্তু মাংস তেল চর্বি বেশি খাওয়ায় পানির অভাব আরো বেশি দেখা দেয়। ফলে অনেকেই, বিশেষ করে বৃদ্ধরা, সমস্যায় পড়েন। এক্ষেত্রে ঈদের আগের রাতে বা ঈদের সকালে ইসবগুলের ভুসি পানিতে মিশিয়ে খেয়ে নিতে পারেন। সকালে ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সেমাই পায়েসের সঙ্গে সঙ্গে ফলের রস খেতে পারেন। এর সঙ্গে প্রচুর পানি পান করে নেবেন। ঈদের দিন দুপুর ও রাতে অবশ্যই সবজির একটি পদ রাখবেন। আর সব খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি বা অন্যান্য পানীয় পান করতে ভুলবেন না।

ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। তাই ঈদে সবার জন্যই থাকে একটু অন্যরকম মজাদার খাবার। খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে মনে রাখতে হবে, খাওয়াটা যেন হয় ভেজালমুক্ত, টাটকা, স্বাস্থ্যসম্মত, সহজপাচ্য এবং উপাদেয়। অবশ্যই হতে হবে পরিমিত এবং পরিকল্পিত। অতি ভোজনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তাহলেই শরীরটা এবং মনটাও সুস্থ থাকবে সবসময়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, অতিভোজন এমনকি স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়ার ফলেও যদি শারীরিক সমস্যা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত