কিশোরীরা কি মানসিক সংকটে রয়েছে?

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি, কথাসাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশ্ন হলো আমাদের দেশের কিশোরীরা কি মানসিকভাবে সংকটে রয়েছে? তারা কি মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি? প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের কি ঘটছে, সে সম্পর্কে তত্ত্ব আছে; কিন্তু কিশোরীদের সম্পর্কে কি তথ্য আছে? সোশ্যাল মিডিয়া কি তাদের দুর্ভোগের একটি কারণ? পুরুষরা কি কোনোভাবে তাদের সমস্যার অংশ? লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কিশোরদের চেয়ে আমাদের দেশে কিশোরীরা শান্ত এবং কখনও কখনও আশ্চর্যজনক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। তবে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের হার বেশি। বিএমজি সাইকিয়াট্রিতে গত ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ অনুসারে, বাংলাদেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের ৭৩.৫ শতাংশের মাঝেই মানসিক চাপজনিত কোনো না কোনো লক্ষণ দেখা গেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাশের মাঝে মাঝারি ধরনের মানসিক চাপের উপসর্গ দেখা গেছে। ৯ শতাংশ উচ্চচাপজনিত উপসর্গে ভুগছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেয়েদের মানসিক চাপ ছেলেদের চেয়ে বেশি ছিল। বিবিসি ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের ১৩-১৯ বছর বয়সি শহুরে ছেলেমেয়েদের ৬০ শতাংশের বেশি মাঝারি থেকে তীব্র মানসিক চাপে ভোগে। এ মানসিক চাপের ফলে তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিশোরীদের একটি বড় অংশ স্থূলতা এবং বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভোগে। পুরুষের কাছ থেকে যৌন হয়রানির ভয়, অবাঞ্ছিত বন্ধুত্ব এবং ভয়ংকর হুমকির সম্মুখীন হয় কিশোরীরা। আমাদের দেশে বেশিরভাগ কিশোরীর মধ্যে নিয়মিত খেলাধুলা করার হার কম। কিশোরীদের মানসিক চাপের ব্যাপারে পরিবারে বা অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম। ফলে মানসিক চাপ সামলাতে পরিবার, সমাজ এবং স্কুলের সহায়তাও খুবই কম পায় তারা।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৫-১৭ বছর বয়সি স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৮ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীরা নানা রকম মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। আর হরমোনের নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার চাপ। মানসিক চাপ বোধ করে পড়াশোনা নিয়েও। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, স্কুলের পারফরম্যান্স এবং রোমান্টিক সম্পর্কের কারণেও মানসিক চাপে পড়ে তারা। নিজেদের শারীরিক অবয়ব মানে তাদের কেমন দেখাচ্ছে, তা নিয়েও কিশোরীরা মানসিক চাপে থাকে। মা-বাবার মানসিক দূরত্ব, নাগরিক জীবনে একক পরিবার কাঠামোর কারণে একাকিত্ব, স্কুলে বা অবসর সময়ে সমবয়সিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। মানসিক চাপের কারণে অল্প বয়সি মেয়েদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। প্রায়ই নিজেদের সমস্যার কথা পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। সমস্যা কথা শেয়ার করা, কিংবা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধু বা সমবয়সিদের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে কিশোরীরা সমাজের বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজালে অতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন হয়, যা তাদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ। এর প্রভাবের ফলে আত্মহণনের প্রবণতাও দেখা দেয়।

কিশোরীরা যেসব সমস্যা ভোগ করে, তার মধ্যে একটি হলো যৌন হুমকি। সমাজে অনেক লোক নারীর দেহকে যৌনতা হিসেবে দেখে। এসব কারণে কিশোরীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুন। কিশোরীরা অশ্লীল রসিকতা, অনুপোযুক্ত স্পর্শ, যৌন হুমকি বা সহিংসতার শিকার হয়। তারা এসব অবাঞ্ছিত মনোযোগ অপ্রতিরোধ্য ও মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করতে থাকে। কিশোরীরা বিষণ্ণতার মাঝে বেড়ে উঠতে থাকে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যর জন্য উদ্বেগজনক।

কিশোরীরা স্বাভাবিক আবেগ প্রকাশ করতে ততটা উৎসাহিত কি? কারণ আমাদের দেশের পূর্ববর্তী প্রজন্ম তা সহ্য করে না। কিশোরীরা সাধারণত বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ দ্বারা কিশোরদের চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়ে। কিশোরী মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি অনুভূতিশীল এবং আবেগী। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো কিশোরীদের মানসিক সমস্যার আর একটি কারণ। সোশ্যাল মিডিয়া কিশোরীদের নিজেদের সম্পর্কে চিন্তা করার এবং অনুভব করার উপায়কে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে, ভাল এবং খারাপ উভয় উপায়ে। অনলাইনে অন্যদের সঙ্গে নিজে তুলনা করার সময় তারা নিখুঁত হওয়ার চাপ অনুভব করে।

শিশু-কিশোররা অন্তত ১৪ ধরনের মানসিক ও শারীরিক জটিলতায় ভুগছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে ৫-১৭ বছরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৮ শতাংশ অন্তত একটি শারীরিক বা মানসিক জটিলতায় ভুগছে। এর মধ্যে শারীরিক অক্ষমতা যেমন চোখে কম দেখা শ্রবণ সমস্যা, হাঁটার সমস্যা। মানসিক জটিলতার মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, বন্ধু তৈরিতে সমস্যা, মনে রাখার সমস্যা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা। ভুক্তভোগীদের ১০ শতাংশ অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান আর অতিধনী পরিবারের সন্তান ৬ শতাংশ। ২১ শতাংশ বরিশাল ও ১৮ শতাংশ ময়মনসিংহের বাসিন্দা। ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে আচরণ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা রয়েছে যথাক্রমে ৩ ও ২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার ৯ শতাংশ। শহরাঞ্চলের চেয়ে এটি ২ শতাংশ বেশি। গবেষণার তথ্য বলছে, বয়ঃসন্ধিকালের ১০-১৯ বছর পর্যন্ত সময়কে শৈশব পরবর্তী ক্রান্তিকাল হিসেবে ধরা হয়।

এ সময়ে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক পরিবর্তন, অপব্যবহার বা সহিংসতা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ছেলেদের মধ্যে এ হার ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও মেয়েদের মধ্যে তা ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ডিজিটাল আদমশুমারি ২০২২-এর তথ্য মতে, ২০০১ সালে দেশে ১০-১৯ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১১ সালে তা মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে দেশে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯৬ জন, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এ বিশাল সংখ্যক কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা, জীবন-দক্ষতা ও স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ।