ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আগুনে বাড়ছে কান্না

জিহাদ হোসেন রাহাত, তরুণ কলামিস্ট, [email protected]
আগুনে বাড়ছে কান্না

আগুন মানে না নিয়ম, তোয়াক্কা করে না বাধা। সাম্প্রতিক সময়ে পরপর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যেন এক গোলক ধাঁধা। এপ্রিলের শুরুতে পুড়ল দেশের রাজধানী শহর ঢাকার বঙ্গবাজার। এই ঘটনার সপ্তাহ পার না হতেই বঙ্গবাজার সংলগ্ন হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন শপিং মলে লাগে আগুন। তার দিন কয়েক না যেতেই ১৫ এপ্রিল ভোর ৫টা নাগাদ ফের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে রাজধানী শহর ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেটে। বারবার এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে জন্ম দিচ্ছে অজানা এক উদ্বেগের। এগুলো কোনো গোলকধাঁধার মতো নাশকতা কিংবা পরিকল্পিত কাজ নয় তো?- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। আবার কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবছেন- অব্যবস্থাপনায় অগ্নিদুর্ঘটনা আর কত?

তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, চির সবুজ বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা অন্তত আরো এক যুগ আগেই হারিয়েছে নিজের বাসযোগ্যতা। গণপূর্ত অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ তথ্য বলছে, ঢাকার অন্তত ৮০ শতাংশ ভবন ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়নি। অবশ্য এ সংখ্যার প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশই অযোগ্য ঠিকাদার দ্বারা নির্মাণ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, যদি এখানে তুরস্ক ও সিরিয়ার মতো স্মরণকালের একটি ভূমিকম্প হয়, তাহলে মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে এটি। অধিক পরিমাণে ঘনবসতি এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ধ্বংসস্তূপ থেকে আহত মানুষ উদ্ধার করা তো দূরে থাক, লাশ উদ্ধার করতেও আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।

বর্তমানে যে হারে এ শহরে নগরায়ণ বাড়ছে, ঠিক একই হারে বিপর্যস্ত হচ্ছে এখানকার পরিবেশ। এমন অবস্থা দেখে দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, আর কয়েক দশক পরেই মানুষ নিজকে বাঁচাতে এই শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। আমাদের উদ্বেগ এখানেই শেষ নয়। আরেকটি বড় ব্যাপার হলো, এই শহর বিকেন্দ্রীকরণ তথা জনবসতি কমানো নিয়ে নেই কোনো উদ্যোগ, নেই শহরটির জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য কোনো তোড়জোড়। ঢাকার এমন বেহাল দশা থেকে আগের রূপে ফিরতে প্রয়োজন কিছু উদ্যোগ। আর সেগুলো হলো, পরিবেশ দূষণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে এমন কিছু কলকারখানা সরিয়ে ফেলা। প্রয়োজন ক্ষীণ কিছু সরকারি দপ্তর এবং মন্ত্রণালয় অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। বিশেষ করে বুড়িগঙ্গা-তুরাগসহ আশপাশের নদীগুলোর দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। নির্মাণ হতে যাওয়া সম্ভাব্য স্থাপনাগুলোকে নির্মাণ নিয়ম মানতে বাধ্য করা ইত্যাদি। ফলে যেমন সুন্দর হবে ঢাকার পরিবেশ ঠিক তেমনিই এমন অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

একটু লক্ষ করলেই আমরা দেখতে পাই, সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো ভয়াবহ আগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যেমন, বঙ্গবাজার, বঙ্গবাজার সংলগ্ন হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন শপিং মল, পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজার, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পরপর দুটি ঘটনা, নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস এবং গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেট কিংবা সর্বশেষ এই নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেট। এর প্রায় প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে আমাদের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গবাজার ট্র্যাজেডিতে ফায়ার ডিফেন্সের পানির প্রধান উৎস ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পুকুর। আবার নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পানির উৎস হয় ঢাকা কলেজের একটি পুকুর। পানির উৎসের এমন অবস্থা দেখে বোঝার বাকি থাকে না দেশে অব্যবস্থাপনার মাত্রা কতটুকু বেড়েছে।

মূলত কোনো স্থাপনা কিংবা ভবনকে পর্যাপ্ত আগুন প্রতিরোধক করতে হলে আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণগুলো পুরোপুরি খুঁজে বের করে তার জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রাখাই এখন পর্যন্ত অগ্নিনিরাপত্তা বিধানের সবচেয়ে কার্যকর উপায় তথা মাধ্যম। এটিকে এক ধরনের আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থাও বলা চলে। অথচ দুঃখের বিষয় হলো, বঙ্গবাজারের পাশেই ফায়ার ডিফেন্সের সদর দপ্তর থাকা সত্ত্বেও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি বঙ্গবাজারকে। অবশ্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বঙ্গবাজার অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে মর্মে কয়েকবার নোটিশ প্রদান করা হলেও তা আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ এখানেও দায়ী চরম অব্যবস্থাপনা। আবার কাছাকাছি পর্যাপ্ত পানির উৎস না থাকায় চরম বিপাকে পড়তে হয় ফায়ার ডিফেন্স কর্তৃপক্ষকেও- এটিও এক ধরনের অব্যস্থাপনা। এটির দায় সরকারসহ কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না।

এখন প্রশ্ন হলো, আর কত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ভাঙবে আমাদের ঘুম? না কি জেগে ঘুমোচ্ছি আমরা?- এ সমস্যার উত্তরণে সরকারসহ সব পক্ষকে সমানভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি ফায়ার ডিফেন্সসহ সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ভবন নির্মাণসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং একটি জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তাহলেই হয়তো সকলের সমান প্রচেষ্টা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনার পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত