অভিমত

প্রেসক্রিপশন হোক স্পষ্টাক্ষরে

মাহমুদুল হক হাসান, মুক্তমনা লেখক

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রেসক্রিপশন শব্দটির সঙ্গে সবাই মোটামুটি পরিচিত। সাধারণত ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ককে বলা হয় প্রেসক্রিপশন সম্পর্ক। অর্থাৎ ডাক্তারের কাছে রোগীর পরিচয় শুধু পুরোনো একটা প্রেসক্রিপশনই বহন করে। যে কাগজটি পরম মমতা ও আশ্বস্ততার বন্ধনে রোগীরা সযত্নে নিরাপদে দীর্ঘ একটা সময় পাহারা দেয়। যদি সেই আশ্বস্ততা ও পরম মমতার বন্ধনটি থাকে দুর্বোদ্ধ, মানহীন ও অজানা আঁকাবুকি তাহলে তা সত্যিই পীড়াদায়ক। দেশের অধিকাংশ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে হস্তলিখন এতটাই ঝলমলে দুর্বুদ্ধ যে, অনেক সময় প্রেসক্রিপশনের লেখা আবিষ্কার করতে গিয়ে ফার্মেসির বিক্রয়কর্মীদেরও মস্তিষ্কের কলকব্জা হ্যাং হয়ে যায়। প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাহারি আলোচনার শেষ নেই। ডাক্তারদের অস্পষ্ট ব্যবস্থাপত্র দেখে অনেকেই বলেন চিকিৎসকরা ওষুধের সাইফার কোড বা এক ধরনের গোপন চিহ্ন ব্যবহার করেন, যাতে করে পার্টিকুলার ফার্মেসি ছাড়া অন্য কোনো ফার্মেসি সেটা বুঝতে না পারে। আবার কারো কারো মতে, ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টদের গোপন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হলো এই প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসকদের কাছ থেকে লিখিত দুর্বুদ্ধ প্রেসক্রিপশন কোনোভাবেই কাম্য নয়। অস্পষ্ট ব্যবস্থাপত্র শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা নয় বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। ডাক্তারদের হাতের লেখা বুঝতে না পারায় ও ভুল ওষুধ সেবন করায় প্রতিবছর ১৫ লাখ রোগী অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সমস্যার সমাধানকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নেপসি’ নামের একটি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে, যার ফলে চিকিৎসকরা হাতে লেখার পরিবর্তে ইলেকট্রনিক প্রেসক্রিপশন লেখার সুবিধা পাচ্ছেন। এতে সমস্যা আনকটা হ্রাস পাচ্ছে। বানানে সামান্য এদিক সেদিক হলে প্রোডাক্ট, ব্র্যান্ড ও জেনেরিক নামের মধ্যে গোলযোগ বেধে যায়। চিকিৎসকদের অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশনের ও ভুল ওষুধ সেবনের ঘটনা এদেশে নতুন কিছু নয়। আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন আইওএমের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের হাতের লেখা বুঝতে না পারার ফলে বিশ্বে প্রতিবছর ৭ হাজার রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। যেখানে একটা প্রেসক্রিপশন এর ওপর রোগী ও তার পরিবার চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে। চিকিৎসকদের দেখা পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসার ঝুরি নিয়ে বসে থাকে সেখানে চিকিৎসকদের কাছ থেকে দুর্বুদ্ধ লিখিত প্রেসক্রিপশন কোনোভাবেই কাম্য নয়। একজন ডাক্তার রোগী ও তার স্বজনদের কাছে আস্থা, ভরসা, অগাধ বিশ্বাস, ভালোবাসা ও নির্ভরতার নাম। সমাজের সর্বস্তরের লোকদের কাছে ডাক্তারের সম্মান আকাশচুম্বী। ২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি চিকিৎসকদের স্পষ্ট করে পড়ার উপযোগী প্রেসক্রিপশন লেখার নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। প্রেসক্রিপশনের অস্পষ্ট লেখা সম্বন্ধে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা জনপ্রিয় ও সিনিয়র চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে দ্রুত লিখতে গিয়ে এই সমস্যার সৃষ্টি। আবার বড় বড় সার্জনের হাতের লেখা অস্পষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, তারা অধিক সময় জটিল সব অস্ত্রোপচার ও বিভিন্ন কাটাছেঁড়ার কাজ শেষে চ্যাম্বারে ব্যবস্থাপত্র যখন লিখতে বসেন তখন হাতের লেখা ভালো করতে পেশিতে যে ফাইন টিউন থাকা প্রয়োজন তা না থাকার ফলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের লেখা প্রেসক্রিপশন অস্পষ্ট। এহেন পরিস্থিতিতে সার্জনদের সহযোগী কম্পিউটার টাইপিস্ট নিয়োগ করা দরকার। তবে প্রেসক্রিপশনে অস্পষ্ট লেখা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। একই সঙ্গে চিকিৎসকদের উচিত রোগীদের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করা। এতে রোগীরা চিকিৎসকদের কথায় যেমন আশ্বস্ত হবেন তেমনি সুচিকিৎসার ভরসাও পাবেন। ফলে ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক তখন আর কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বাস্তব জীবনেও সুফল বয়ে আনবে। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের সুদৃষ্টি দিতে হবে। যদিও দেশে বেশ কিছু হাসপাতালে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র তথা প্রেসক্রিপশন কম্পিউটারাইজ করা হচ্ছে, তবে এটি খুবই অপ্রতুল। বিশ্বনন্দিত প্রতিষ্ঠান ব্রিটেনের দ্য একাডেমি অব মেডিকেল রয়েল কলেজেস চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে সহজ ইংরেজি লেখার নির্দেশনা দেয়। শুধু সহজবোদ্ধ ব্যবস্থাপত্র লিখতেই বলা হয়নি বরং রোগীর সঙ্গে সুন্দর সম্বোধন ও রোগীর মানসিক অবস্থাকেও বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। চিকিৎসকদের এ বিষয়ে খেয়াল করা দরকার যে, প্রেসক্রিপশন তিনি রোগীর জন্য লিখছেন। আর রোগী শিক্ষিত-অশিক্ষিত দুটোই হতে পারে, তাই রোগী যেন তার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র অন্তত পড়তে পারে এবং প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেনে চলতে পারে। এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের সুদৃষ্টি দিতে হবে।