প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর

বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের নতুন মোড়

ড. সাবেরা চৌধুরী, সিনিয়র গবেষক, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা

প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্মুক্ত ও বাণিজ্যমুখী অর্থনীতি হওয়ায় ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে একটি প্রতিশ্রুতিশীল এবং লাভজনক ব্যবসায়িক গন্তব্য হয়ে উঠছে। জাপান বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশের ১৭০ মিলিয়ন শক্তিশালী ভোক্তা বাজার, একটি বর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি, উন্নত ক্রয় ক্ষমতা, স্থানীয় চাহিদা, সহজলভ্য শ্রম এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে জাপান দ্বিপক্ষীয় সংযোগ জোরদার করতে আগ্রহী। মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে অতি নির্ভরশীলতা এবং সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হওয়ার উদ্বেগের কারণে, জাপান চীন থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাপানি ব্যবসার জন্য একটি লোভনীয় বিকল্প হতে পারে। এরই মধ্যে পূর্ব এশিয়ার দেশটি বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাফল্য জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।

১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সালে টোকিও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। জাপান ১৯৭২ সাল থেকে সেদেশের সরকারি উন্নয়ন সহায়তা (ODA)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নে উদারভাবে অবদান রেখেছে এবং শীর্ষস্থানীয় দ্বিপক্ষীয় দাতা থেকে নাম লিখিয়েছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির মতে, বাংলাদেশ জাপান থেকে সবচেয়ে বেশি ওডিএ পায়। ২০১৪ সালে, বাংলাদেশ এবং জাপান একটি ব্যাপক অংশীদারিত্ব শুরু করে, যার ফলে আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি পায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে জাপান বাংলাদেশকে ২.৬৩ বিলিয়ন সাহায্য দিয়েছে, যা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে জাপান আনুমানিক ২৪.৭২ বিলিয়ন ডলারের অনুদান ও ঋণ দিয়েছে। জাপান বাংলাদেশকে এনার্জি ও পাওয়ার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অবকাঠামোর উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করে। গ্যাস ও কয়লা, ব্লু ইকোনমি, স্বাস্থ্য এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো খাতে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বিনিয়োগ সম্পর্ক সম্প্রসারিত হচ্ছে।

জাপানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে বিবেচনা করছে। ১০ বছর আগে বাংলাদেশে মাত্র ৮২টি জাপানি কোম্পানির শেয়ার ছিল। গত এক দশকে এ সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। গত বছর থেকে বাংলাদেশে ৩০০টি জাপানি কোম্পানি কাজ করছে, যা ২০১৮ সালে ২৭৮টি, ২০১৭ সালে ২৬০টি এবং ২০১৬ সালে ২৪৫টি ছিল। বাংলাদেশ ও জাপান ১২ আগস্ট, ২০২০-এ একটি আর্থিক চুক্তি ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে সাতটি বাংলাদেশি মেগাপ্রজেক্টে জাপানি বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নিঃসন্দেহে এ কর্মসূচিগুলো বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে সাহায্য করবে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জাপান উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করছে। প্রকৃতপক্ষে, কৌশলগত অবস্থানের কারণে একমাত্র দেশ হিসেবে জাপানকে উত্তর-পূর্ব ভারতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশ, ভুটান, চীন এবং মিয়ানমার দ্বারা স্থলবেষ্টিত। এ অঞ্চলটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ ধারণার বিকাশে ভূমিকা পালন করেছে, যা জাপানেরও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রাথমিকভাবে এ ধারণাটির প্রস্তাব করেছিলেন এবং পরবর্তী সরকারগুলো এটি এগিয়ে নিয়ে যায়। এর অংশ হিসেবে জাপান ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি রুলস-বেজড-অর্ডার বজায় রাখার জন্য কাজ করছে।

জাপানের নতুন ‘মুক্ত এবং অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক’ কৌশল ঘোষণা করার সময় প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একক অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে সমগ্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়তা করার জন্য, জাপান বাংলাদেশ এবং ভারতের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ‘বাংলাদেশ-উত্তর-পূর্ব ভারত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালু চেইন কনসেপ্ট’ নিয়ে কাজ করতে চায়। বাংলাদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলে ব্যবসার সুযোগ অনুসন্ধানের জন্য ভারত ও জাপান এর আগে একটি ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ সম্মেলন করে যেখানে বহুমাত্রার সংযোগের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসিকে টোকিওর বৃহত্তর বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি উপাদান হতে বলেছে জাপান।

এছাড়া জাপান ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি)-এর জন্য তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করেছে, যেখানে বঙ্গোপসাগরের বৃহত্তর কমিউনিটির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সমন্বিত উন্নয়নের আহ্বান জানানো হয়।

এশিয়ায় বাংলাদেশের প্রাথমিক রপ্তানি বাজার হল জাপান। যদিও গত ১০ বছরে জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, তবুও সে দেশে বাংলাদেশের ব্যাপক বাণিজ্য সম্ভাবনা এখনও অধরাই রয়ে গেছে। ২০১৪ সালের এক পিউ রিসার্চ জরিপ অনুসারে, ৭১ শতাংশ বাংলাদেশি জাপানকে সমর্থন করে, যা এটিকে এশিয়ার সবচেয়ে জাপানপন্থি দেশগুলোর মধ্যে একটি করে তুলেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাপানের পক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে (UNSC) অস্থায়ী সদস্য পদের জন্য তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে।

দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানের কৌশলগত ও কূটনৈতিক এজেন্ডায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু জাপানের জন্য বিনিয়োগবান্ধব হাব হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। উপরন্তু, প্রযুক্তিগত জ্ঞান হস্তান্তর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। জাপানের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর হতে পারলে আগামী বছরগুলোতে লাভবান হবে বাংলাদেশ। তবে এক্ষেত্রে জাপানকে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দিতে হবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বর্তমান বাধাগুলো, যেমন দীর্ঘায়িত শুল্ক ছাড়পত্র, দ্বৈত কর ব্যবস্থা এবং বৈদেশিক মুদ্রার উদ্বেগ দূর করার জন্য উভয় পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক বিবেচনার পাশাপাশি, ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন টোকিওকে নয়াদিল্লির বাইরে তার দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি কাঠামো পুনর্বিবেচনার সুযোগ দেবে। অন্যদিকে, জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাংলাদেশকে তার পূর্ণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পর আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করবে। ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্যসেবা, সুনীল অর্থনীতি, উচ্চ প্রযুক্তি শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, অটোমোবাইল উৎপাদন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা উভয় দেশের বন্ধন আরও দৃঢ় করবে।