ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গভবন : রাষ্ট্রপতিদের আগমন-প্রস্থান

ড. এ. এইচ. এম মাহবুবুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
বঙ্গভবন : রাষ্ট্রপতিদের আগমন-প্রস্থান

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১তম প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ বঙ্গভবন থেকে গত ২৪ এপ্রিল যে রাজসিক বিদায় নিয়েছেন, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দেশের ইতিহাসে বিগত ১৯ জন রাষ্ট্রপতির কেউ এমনভাবে হাসিমুখে বিদায় নিতে পারেননি। বঙ্গভবনে অবস্থান করা রাষ্ট্রপতিদের আগমন-প্রস্থানের ইতিহাস সুখ-দুঃখে মিশ্রিত। বঙ্গভবন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন। বঙ্গভবনের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ব বঙ্গ ও আসাম সরকার মানুক নামের এক জমিদারের কাছ থেকে দিলকুশা এলাকার এ জায়গাটি ক্রয় করে ভারতের ভাইসরয়দের বসবাসের জন্য। মতিঝিলের এ ফাঁকা জায়গাটিতে দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণ করা হয় পরবর্তী সময়ে। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত লর্ড কার্জন এ ভবনেই বাস করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার গভর্নরের সরকারি বাসভবন হিসেবে ভবনটি ব্যবহৃত হলে তখন ‘গভর্নর হাউস’ নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ থাকার কারণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের কলকাতায় প্রবাসী সরকারের সদরদপ্তরে অবস্থান করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে এই ভবনে বসবাসের জন্য উঠলে গভর্নর হাউসের নামকরণ করা হয় ‘বঙ্গভবন’। তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী তার দায়িত্ব শেষ করেন ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর। চতুর্থ রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার মোহাম্মদ মাহমুদউল্লাহ ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে ওঠেন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গভবনে অবস্থান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিলেও ৩২ নম্বর ধানমন্ডির নিজের বাড়ি ছেড়ে বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনে ওঠেননি। মূলত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ধানমন্ডির বাড়ি রেখে বঙ্গভবনে উঠতে রাজি হননি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ নিজেকে দেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বঙ্গভবনে ওঠেন। এ বঙ্গভবন থেকেই খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার রাজনৈতিক সহচর জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় খোন্দকার মোশতাক। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়া সপ্তম রাষ্ট্রপতি সায়েমকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং অপমানজনকভাবে বঙ্গভবন থেকে বের করে দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেনারেল জিয়া এ বঙ্গভবন থেকেই রাজনৈতিক দল করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বহাল করেছেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হন ।

জেনারেল জিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার নবম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৩০ মে, ১৯৮১ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৮২ পর্যন্ত বঙ্গভবনে অবস্থান করেন। তার প্রস্থানও সুখকর হয়নি। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাতের বেলা বিচারপতি সাত্তারকে অপসারিত করে দশম রাষ্ট্রপতি হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তিন দিন পর পদত্যাগ করে ২৭ মার্চ ১৯৮২ একাদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে রাতের অন্ধকারে রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে বিদায় করে দ্বাদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন। জেনারেল এরশাদ দীর্ঘ ৭ বছর বঙ্গভবনে অবস্থান করে স্বৈরাচার উপাধী নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মুখে রাতের অন্ধকারে ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর বঙ্গভবন ত্যাগ করেন।

১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি এরশাদ বঙ্গভবন থেকে লজ্জাজনকভাবে অপসারিত হলে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন। ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বিচারক পদে ফিরে যান। চর্তুদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১০ অক্টোবর ১৯৯১ সালে শপথ নেন বিএনপির আব্দুর রহমান বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী হিসেবে আব্দুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনকে কলঙ্কিত করেছেন বলেও তুমুল সমালোচনা হয়। নানা সমালোচনা মাথায় নিয়ে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর আব্দুর রহমান বিশ্বাস বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে ৯ অক্টোবর ১৯৯৬ সালে বঙ্গভবনে ওঠেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ২০০১ সালে বিএনপি সমর্থিত সরকারের নানা চাপে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ১৪ নভেম্বর বঙ্গভবন ছাড়েন। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী শোড়ষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন ১৪ নভেম্বর ২০০১ সালে। ২০০২ সালে ৩০ মে জেনারেল জিয়ার মাজারে ফুল দিতে যাননি বলে রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অপমানজনকভাবে ২১ জুন পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দল থেকে অপসারিত হয়ে মহাখালীতে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নিজের রাজনৈতিক দল বিকল্পধারার একটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপি দলীয় নেতাকর্মী দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন।

২০০২ সালের ২১ জুন সপ্তদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। তিনি মাত্র ৪ মাস অবস্থান করার পর ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ সালে অপসারিত হন। ৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ সালে অষ্টাদশ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দীন আহমেদ। বিএনপি দলীয় আনুগত্যের কারণে রাজনৈতিক নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ইয়াজউদ্দীন আহমেদ। শেষ অবধি বিএনপিকে ফের ক্ষমতায় আনতে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। ফলে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ইয়াজউদ্দীন আহমেদ ও বিএনপির চক্রান্তের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে ১১ জুন ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ইয়াজউদ্দীন আহমেদ। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতির সম্মানজনক পদবিকে কলুষিত করে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জিল্লুর রহমান ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ইন্তেকাল করেন। এক মাসের জন্য ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে ওঠেন অ্যাডভোকেট মোঃ আবদুল হামিদ। ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেন ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। সফলতার সঙ্গে ৫ বছর বঙ্গভবনে অবস্থান করে দ্বিতীয় মেয়াদে ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে বঙ্গভবনে অবস্থান করেন। ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল ৫ বছর মেয়াদ শেষ করে বাংলাদেশের ইতিহাসে সফলতম ও সন্তুষ্টচিত্তে বঙ্গভবন ত্যাগ করলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। রাজসিক সংবর্ধনা আর ফুলের পাপড়ি ছড়ানো পথে হাসতে হাসতে চোখেমুখে সুখের দ্যুতি ছড়িয়ে বঙ্গভবন ছেড়ে গেলেন রাষ্ট্রপতি। এ দিনটি ইতিহাস হয়ে থাকল। ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে উঠলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। অপেক্ষায় থাকলাম বঙ্গভবন যেন আবার রাষ্ট্রপতির এমন রাজসিক প্রস্থান দেখে। অতীতের সব গ্লানি মুছে যাক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সূবর্ণ শাসনামলে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত