ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের রাজসিক বিদায়

সৈয়দ ফারুক হোসেন, রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের রাজসিক বিদায়

‘রাজনীতিবিদকে দেশের মানুষকে ভালোবেসে রাজনীতি করা উচিত। তাহলেই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে।’ বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে তার বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন। সর্বোচ্চ সম্মান ও রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী আবদুল হামিদকে নিকুঞ্জের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার আগে থেকেই ওই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি বাইরের মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়। বর্ষীয়ান এ রাজনীতিক এখন থেকে সেখানেই অবস্থান করবেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দেশের মানুষকে ভালোবেসেই সারা জীবন রাজনীতি করে গেছেন। মানুষের ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়েছেন। টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর মানুষের ভালোবাসায় তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও ভারপ্রাপ্ত এবং চলতি দায়িত্বে হিসেবে আরও ৪১ দিন তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। দেশের মানুষ রাষ্ট্রপতিকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। তাই মানুষের সেই সম্মান তিনি অটুট রাখতে চান। সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বলেছেন, অবসর জীবন তিনি বই পড়ে ও লেখালেখি করে কাটাবেন। তবে নতুন করে আর কোনো রাজনীতিতে জড়াবেন না। মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের পহেলা জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজী মোঃ তায়েব উদ্দিন এবং মাতার নাম তমিজা খাতুন। মোঃ আবদুল হামিদ, তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করা তার প্রিয় শখ। আবদুল হামিদ একজন বাংলাদেশি প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের ?২০ ও ২১তম (ব্যক্তি হিসেবে ১৭তম) রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ নিকলী জিসি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ ও বিএ ডিগ্রি এবং ঢাকার সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছিল রাজসিক বিদায়। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে দুই মেয়াদে দীর্ঘ সময় অর্থাৎ ১০ বছর ৪১ দিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর অবশেষে সোমবার বঙ্গভবন ছাড়লেন সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। অপরদিকে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। নতুন রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পালন করবেন, এটা সারা জাতির প্রত্যাশা। মো. সাহাবুদ্দিন ব্যক্তিগত জীবনে এক সন্তানের পিতা এবং তার স্ত্রী প্রফেসর ড. রেবেকা সুলতানা সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব ছিলেন। তিনি ছাত্রজীবনে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৫ সালে সংঘটিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর কারাবরণ করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে মো. সাহাবুদ্দিন শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ৫ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আগে মোঃ সাহাবুদ্দিন ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। তিনি ১৯৪৯ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এর আগে জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৯৫ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গভবনের দরবার হলে দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিন শপথ নেয়ার পর চেয়ার বদলের মাধ্যমে তার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা সারেন বিদায়ী রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদ। নতুন রাষ্ট্রপতির শপথের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করে বঙ্গভবন থেকে সস্ত্রীক বিদায় নেন আবদুল হামিদ।

এ সময় বঙ্গভবনে তাকে দেয়া হয় বিদায়ী গার্ড অব অনার। লালগালিচা সংবর্ধনার পাশাপাশি পুষ্পশোভিত গাড়িতে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বিদায় জানানো হয় তাকে। প্রথমবারের মতো কোনো রাষ্ট্রপতি এমন রাজসিক আয়োজনে বঙ্গভবন ছাড়লেন। দুপুর ১টার পর শুরু হওয়া এ বিদায় অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের সুসজ্জিত একটি দল বিদায়ী গার্ড অব অনার দেয় আবদুল হামিদকে। অগ্রভাগে অশ্বারোহী দল, তাদের পেছনে তিন বাহিনীর ব্যান্ড দল বাদ্যযন্ত্রে তুলছিল দেশাত্মবোধক গানের সুর। এর পর তিনি লাল গালিচায় হেঁটে গার্ড পরিদর্শন করেন। গার্ড অব অনার পর্ব শেষে আবদুল হামিদ ও তার সহধর্মিণী রাশিদা খানম ওঠেন ফুল দিয়ে সাজানো একটি খোলা জিপে। বঙ্গভবনের বক ফোয়ারা থেকে প্রতীকী কায়দায় সেই ‘প্যারেড কার’কে দুটি রশি ধরে মূল ফটকে টেনে নিয়ে যান বঙ্গভবনের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরারা। বিদায় বেলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন, সে জন্য তার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ। আর কৃতজ্ঞ সাংবাদিকদের কাছে, কারণ তার বক্তব্য তারা টুইস্ট না করে জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তার যেটুকু সাফল্য সেজন্য তিনি দেশের মানুষের কাছে এবং এলাকার মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় দেশের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করার পর ভারমুক্ত হলেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বঙ্গভবন ছেড়ে সস্ত্রীক উঠেছেন রাজধানীর নিকুঞ্জের ‘প্রেসিডেন্ট লজে’। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, আপনারা শুনেছেন, অনেক সময় আমি বলেছি, আমি বন্দি জীবনে আছি। এর থেকে আমি মুক্তি পাচ্ছি। এখন সাধারণ নাগরিক হিসেবে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারব। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ দেশের মানুষ আমাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতি পদে দুই মেয়াদে নির্বাচিত করেছে। আবার রাজনীতি করলে এ দেশের মানুষকে হেয় করা হবে। সেটা আমি করব না। নিজের রাজনৈতিক জীবন এবং রাজনীতিবিদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি সারাজীবন মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি। মানুষের বাইরে কোনো চিন্তা ছিল না। কোনো দিন থাকবেও না।

আমি দেশের সব রাজনীতিবিদকেও এ কথাই বলব, এ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে যেন তারা রাজনীতি করেন। তাহলে রাজনীতি আরও অনেক সুন্দর হবে। তিনি বলেন, দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে আমি এটি আশা করি। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি সব সময় নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ মনে করতেন। তার যে রাজনীতি, সেটা ছিল সাধারণ মানুষের জন্য। চেষ্টা করেছেন দেশে সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে, যেন আগামীতেও সে চেষ্টা অব্যাহত থাকে। দেশের মানুষ সব দিক থেকে ভালো থাকুক, সুখী থাকুক তিনি সেটি চেয়েছিলেন। ভালো থাকুন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত