ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পর্যালোচনা

প্রাণের ভাষা জ্ঞানের ভাষা

ড. মো. শওকত হোসেন, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
প্রাণের ভাষা জ্ঞানের ভাষা

শেক্সপিয়রের লিখিত শ্রেষ্ঠতম নাটক হ্যামলেটের নায়ক হ্যামলেট তার বন্ধু হোরেসিওকে একবার বলেছিল : “There are more things in Heaven and Earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy.” আসলেই স্বগে-মর্তে এমন অনেক কিছুই আছে যা হয়তো আমরা বুঝি না বা বুঝলেও অনুভব করলেও অনুরূপ কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। রবীন্দ্রনাথ তাই তো বলেছেন, “ভাষাহারা মম বিজন রোদনা প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা, ...।” তিনি এই অবস্থাকে “বাণীর বেদনা” বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমরা অনেকেই এই বাণীর বেদনায় আক্রান্ত অথবা সবাই কোনো না কোনো সময়ে এই রোগের শিকার। প্রাথমিকভাবে মনে হয়, এর কারণ ভাষার সীমাবদ্ধতা, ভাষাচর্চার সীমাবদ্ধতা এবং ভাষার সাথে হৃদয়ের সামঞ্জস্যহীনতা।

ভাষা ব্যবহারের যোগ্যতা মানুষের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও প্রতিভার মধ্যে অন্যতম। যে ভাষিক পরিমণ্ডলে মানুষ জন্মগ্রহণ ও প্রাথমিকভাবে লালিত-পালিত হয়, সেই ভাষাই হয়ে ওঠে তার দৈনন্দিন কথাবার্তার মাধ্যম। এই ভাষাকেই সাধারণত বলা হয় মাতৃভাষা। মানুষকে তার মাতৃভাষায় সবকিছু করার সুযোগ প্রদান করা হলে সে সর্বাপেক্ষা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে- এতে সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু যারা মাতৃভাষাই ভালো করে বোঝেন না বা মাতৃভাষার বহুমাতৃক ব্যবহারে যারা দক্ষ নন, তাদের দ্বারা মাতৃভাষায়ও যথার্থ ভাব প্রকাশের সুযোগ সংকীর্ণ। আর তাদের চিন্তা করার ক্ষমতাও সংকীর্ণ থাকে। কেননা ভাষা ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারি না। চিন্তার সর্বদাই একটি ভাষিক অবস্থা থাকে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মাতৃভাষায় ওই ভাব চিন্তা না করে অন্য কোনো জানা ভাষায়ওতো করা যায়। অবশ্যই সেটা সম্ভব, এবং অনেকে যারা একাধিক ভাষা জানেন, তারা এমনটি করেও থাকেন। কিন্তু এর রয়েছে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা বা সমস্যা। কেউ যদি মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কোনো কিছু চিন্তা করেন, তাহলে তার ওই চিন্তার সঙ্গে দেশ-কাল ও সংস্কৃতির একটি ছাপও আরোপিত হয়। তিনি যদি সেই দেশে ও সমাজে বাস করেন, যে দেশের বা যে জাতির ভাষা তিনি ব্যবহার করছেন, তাদের সঙ্গেই বসবাস করেন এবং তাদের কাছে ওই ভাষার মাধ্যমে তার চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করেন, তাহলে তেমন কিছু সমস্যা হয়তো হয় না। কিন্তু এক দেশের ও জাতির ভাষা যদি অন্য জাতির ওপর আরোপ করা হয়, এবং অন্য দেশের ভাষায় কথা বলে ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়, লেখা-লেখি বা জ্ঞানচর্চার চেষ্টা করা হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ ও তাৎপর্যের বিভ্রাট ঘটা অস্বাভাবিক নয়। বাঙালি কোনো শিশু যেভাবে তার চারপাশের বস্তুগুলো দেখে, সেসবের নাম শেখে এবং তা ভাষায় প্রকাশ করে, ইউরোপ আমেরিকা বা অন্য কোনো ভীন ভাষাভাষি জাতির শিশুরা ঠিক সেভাবে একই বস্তুর নামকরণ করছে না, একই রকম ভাষা ব্যবহার করছে না। এক ভাষায় কোনো বস্তু যে নামে প্রকাশিত হয় অন্য ভাষায় সেই নামে প্রকাশিত হয় না। এমনকি কোনো একটি বিশেষ বস্তু সম্পর্কে ধারণাও ভাষা-সংস্কৃতির পার্থক্য অনুসারে ভিন্ন হয়ে যায়। মনে করুন মাছ, গাছ, ফল, ফুল ইত্যাদি শব্দগুলো বিভিন্ন ভাষা অনুযায়ী জাতি অনুযায়ী তালিকা করে প্রকাশ করলেন। এখন লক্ষ করুন, প্রত্যেক জাতির সন্তানেরা তাদের মাতৃভাষায় ব্যবহিৃত শব্দগুলো দ্বারা একই বস্তুকে চিনছে ঠিকই, কিন্তু অনুভূতি এবং উদাহরণগুলো তাদের মনের মধ্যে কিন্তু এক রকমভাবে চিত্রায়িত হচ্ছে না। মাছ বলতে একজন বাঙালি সন্তানের যে সব মাছ চোখে ভেসে আসছে অথবা গাছ, ফল, ফুল বলতে তার মনের মধ্যে চিন্তার মধ্যে যে চিত্রগুলো তৈরি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকার বা আরবীয় কোনো শিশুর ধারণা তার থেকে কিছুটা আলাদা হতে বাধ্য। তাদের চিন্তায় ইর্লিশ মাছ, হিজল-তমাল গাছ, বেতের ফল, চালতার ফুল ইত্যাদি চোখে না ভাষারই কথা। ভাষার বৈচিত্র্য অনুযায়ী কোনো শব্দের অর্থগত চিত্র পাল্টে যায়। এমনকি একই দেশের গ্রাম ও শহর অথবা কোনো ভিন্ন উপজাতীয় অঞ্চলের মানুষের নিকট একই শব্দ বা তার অর্থের চিত্র একই রকম হয় না। প্রত্যেকের হৃদয়ের ভাষা গড়ে ওঠে তার আপন সংস্কৃতি দ্বারা, তার চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ দ্বারা। তাই এক দেশি ভাষা-সংস্কৃতির পাঠ অন্য দেশের মানুষ, বিশেষ করে, শিশুদের শিক্ষার মাধ্যম বা বাহন করে দিলে সেই অর্থ ও তাৎপর্যের ভার বহন করার ক্ষেত্রে অনেক বিপত্তি দেখা দেয়। আর সে কারণে জ্ঞানের ভাষা আর হৃদয়ের ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকা একান্ত জরুরি। যেকোনো তথ্য বা জ্ঞানের বিষয় মানুষ সব সময়ই তার হৃদয়ের ভাষায় অর্থকরণ করতে চায়, চিরচেনা সংস্কৃতি বা বোধের সঙ্গে মিলিয়ে চিত্রায়িত করতে চায়।

ভাষা একটি মাধ্যম। চিন্তার মাধ্যম, কথা বলা বা লেখার মাধ্যম। ভাষা জ্ঞানের ধারক, চিন্তার একান্ত অনুষঙ্গ ও বাহক। কিন্তু ভাষায় ব্যবহিৃত যে সকল শব্দ আছে তার প্রত্যেকটিকেই বলা চলে এক একটি চিহ্ন (sign)। এই চিহ্নগুলোর অর্থ সর্বদা সুনির্দিষ্ট নয়। স্থান, কাল, প্রসঙ্গ, সংস্কৃতি, নানা ঘটনা ও বিবর্তনের ভেতর থেকে এই শব্দ-চিহ্নগুলো তাদের দ্বারা প্রকাশিত অর্থের ভিন্নতা ঘটায়।

‘ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর’ (Ferdinand de Saussure) নামক বিংশ শতাব্দীর একজন সুইচ ভাষা দার্শনিক শব্দের এই চিহ্ন-ধর্মী অবস্থা ও অর্থের অস্থায়িত্ব বা ভিন্নতা নিয়ে বিশেষভাবে গবেষণা করেন। তিনি দেখান যে, ভাষায় ব্যবহিৃত শব্দগুলো হচ্ছে এক একটি ভাষা-চিহ্ন, এর দুটি দিক আছে, তা হলো : অর্থ-উদ্দীপক (signifier) এবং আরোপিত অর্থ (signified)। একথা সত্য যে, কোনো একটি শব্দ বা ভাষা-চিহ্নের মাধ্যমেই বা সেটাকে কেন্দ্র করেই কোনো অর্থ নির্ধারিত হয়। তাই ঐ শব্দ বা ভাষা-চিহ্নটি হলো অর্থ-উদ্দীপক। আর যে অর্থটি ঐ ভাষা-চিহ্নের জন্য নির্ধারিত হয় বা ঐ চিহ্নের ওপর প্রয়োগ করা হয় তাকে বলে আরোপিত অর্থ। এখন গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, একই ভাষা-চিহ্ন যাকে আমরা অর্থ-উদ্দীপক বলছি, তা থেকে সব সময় একই অর্থ নির্গমন হয় না। সস্যুরের মতে, এই অর্থ নির্ভর করে কোনো এক নির্দিষ্ট ভাষা-ব্যবস্থার অধীনে অর্থ-উপদীপক ভাষা-চিহ্ন ও তার অর্থ-নির্ধারণের প্রথা, সংস্কৃতি বা কোনো ইচ্ছার ওপর। মানুষ কোনো শব্দের অর্থ হিসেবে কোনো বিশেষ স্থানে ও কালে কোনো কিছুকে গ্রহণ করে। আবার অন্য সময়ে ভিন্ন স্থানে বা ব্যতিক্রম প্রসঙ্গে ওই একই শব্দের অর্থ পাল্টে যেতে পারে। এক্ষেত্রে একটি উদারহণ দেয়া যাক। ধরা যাক ‘নৌকা’ একটি শব্দ। সস্যুরের কথায় একে বলব ভাষা-চিহ্ন। এটি আবার অর্থ-উদ্দীপকও; কেননা এই ভাষা-চিহ্নটি দ্বারা অর্থ উৎপাদন করা হবে। এবার ধরুন ‘নৌকা’ শব্দটি কোনো নদীর ঘাটে যেখানে পারাপারের জন্য সেতু নেই সেখানে কোনো একটি সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে এবং একটি তীর চিহ্ন দিয়ে দিক বা পথনির্দেশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একজন বাঙালি কী বুঝবেন? অর্থটি আমাদের সবার কাছেই বোধকরি সুস্পষ্ট যে, ওই নির্দিষ্ট নদী পারাপারের জন্য কোনো নির্দিশ দিকে ‘নৌকা’ পাওয়া যাবে। এখানে ‘নৌকা’ অর্থ হলো নদী পারাপারে মাধ্যম বা বাহন। এইবার এই একই ‘নৌকা’ শব্দটি অন্য একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে এবং আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, তীর চিহ্ন দিয়ে একটি নির্দিষ্ট অফিস কক্ষ বা একটি ঘর দেখানো হচ্ছে, যেখানে অনেক মানুষের আনাগোনা এবং তার কিছু দূরে রয়েছে একটি ভোট সেন্টার বা নির্বাচনী কেন্দ্র। তীর চিহ্ন দিয়ে যে ঘরটি দেখানো হচ্ছে তার সব বহির্ভাগই নৌকা প্রতীকের ছবিসহ নির্বাচনী পোস্টারে মোড়ানো। এবার কারোরই হয়তো বুঝতে বাকি রইবে না যে, ‘নৌকা’ শব্দ-চিহ্ন দিয়ে যে অর্থ বোঝানো হয়েছে বা এখানের মানুষ বুঝবে তা হলো এটি নির্বাচনের কোনো একটি বিশেষ মার্কা বা প্রতীক। এটি নদী পারাপারের বা কোথাও পানিপথে ভ্রমণের বাহন নয়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আমরা ‘সাইনবোর্ড’ শব্দটি ব্যবহার করেছি উভয় উদাহরণের ক্ষেত্রে। ‘নৌকা’ ভাষা-চিহ্নটি ছেপে দেওয়া হয়েছে উভয় সাইনবোর্ডে। খেয়াল করে দেখুন, ‘সাইন’ অর্থ ‘চিহ্ন’। তাই সাইনবোর্ড হচ্ছে যেখানে কিছু চিহ্ন অংকিত হয়। এই দুটি সাইনবোর্ডে কী কী চিহ্ন অংকিত করা হয়েছে? একই চিহ্ন ‘নৌকা’। কিন্তু দেখুন, দুই স্থানে এই একই ভাষা-চিহ্ন দুই রকম অর্থ প্রদান করছে। উপরে ব্যবহিৃত ‘নির্বাচনী কেন্দ্র’ পদটির দিকে আমরা যদি লক্ষ করি, এর অর্থ ও তাৎপর্য কিন্তু সর্বত্র এক রকম নয়। সত্যিকার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এর যে অর্থ ও তাৎপর্য বহন করে, অন্যদিকে গণতন্ত্রের যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত হয়নি সেখানে ‘নির্বাচন’ বা এই সংক্রান্ত শব্দ বা পদগুলোর অর্থ ভিন্নরকম বোধের সৃষ্টি করে।

ভাষা-চিহ্ন ছাড়াও আমরা অন্য কিছু চিহ্ন বা প্রতীক দিয়েও মাঝে-মধ্যে ভাষার কাজ সেরে দিতে পারি। যেমন রাস্তায় ব্যবহৃত সিগন্যাল লাইট, যাকে ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট বলা হয়। এক্ষেত্রে ‘লাল’ রংটি গাড়ি থামার প্রতীক বা চিহ্ন, ‘হলুদ’ আলো-চিহ্নটি সতর্ক হওয়ার চিহ্ন এবং ‘সবুজ’ আলো-চিহ্নটি নিরাপদে অবাধভাবে চলার চিহ্ন বা সাইন হিসেবে আমরা বুঝে থাকি। কিন্তু এই একই রং-চিহ্নকেই আমরা কি একই অর্থে সর্বত্র ব্যবহার করি? মোটেই না। লাল রঙের কথাই ধরুন। হৃদয় বা হার্টের চিহ্নের মধ্যে আমরা যখন লাল রং ব্যবহার করি বা কোনো বিপ্লবীর পতাকায় যখন লাল রং ব্যবহার করা হয়, তখন সেইসব রং-চিহ্নের অর্থ কিন্তু ট্রাফিক সিগন্যালের লাল রঙের অর্থের মতো নয়। ভাষা ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী অর্থের যে তারতম্য হয়, তাকে মাথায় রাখলে ভিন-দেশি ভাষা তো দূরে থাক, মাতৃভাষায় কোনো কিছুর সঠিক অর্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও পর্যাপ্তভাবে সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ বাস্তবতা ইত্যাদির আনুষঙ্গিক জ্ঞান থাকা দরকার। তাহলেই হৃদয়ের অনুভূতি হয়তো পরস্পর বোঝা যাবে। আমাদের প্রাণের ভাষা হয়ে ওঠে ওই ভাষা, যে ভাষায় আমরা কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবন তথা বাস্তব জীবনাচারের সামগ্রিক দিকের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলি। আমাদের জ্ঞানের ভাষাটিও তাই এই হৃদয়ের ভাষা বা প্রাণের ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া চাই। তা না হলে কেতাবের জ্ঞান আমাদের মস্তিষ্কের কিনারে কিনারে ধাক্কা দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করবে। আর হৃদয়ের জানালা ও প্রাণের অন্তহীন অদৃশ্য প্রাসাদে সেই জ্ঞানের প্রবেশাধিকার হয়ে পড়বে অপ্রত্যাশিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত