প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের তাৎপর্য

সামছুল আলম দুদু এমপি, রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের জাপান সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্র, এর পরে তিনি যুক্তরাজ্যে রাজ্য অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে দেশে ফিরবেন। প্রায় টানা ১৫ দিনের বিদেশ সফর খুবই গুরুত্ব বহন করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে। তবে আমি জাপান সফরের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতেই কলম ধরেছি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার এটা ষষ্ঠ সফর। প্রতিটি সফরেই বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কে গতি সঞ্চার করেছে। নানাবিধ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাধীনতার ১ বছর পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর থেকেই জাপানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বহমান রয়েছে। শেখ হাসিনার এবারের সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭৩ সালে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান সরকারের আমন্ত্রণে দেশটিতে প্রথম সফর করেছিলেন। সেই সফরেই জাপান-বাংলাদেশ আর্থিক সহযোগিতায় দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। সে সময় যমুনা সার কারখানা, কর্ণফুলী সার কারখানা, যমুনা সেতুসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পে জাপানি অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গৃহীত হয়। ঐতিহাসিক সেই সফরটি আজও বাঙালি হৃদয়কে বিভিন্নভাবে আন্দোলিত করে।

আমি সে সময় কলেজ শিক্ষার্থী ছিলাম। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে মাঠে সক্রিয় ছিলাম। বিদেশি গণমাধ্যম ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর সেই সফরের বর্ণনা শুনেছি এবং দেখেছি; সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদ, বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা এবং শিশুপুত্র শেখ রাসেল। জাপানে গার্ড অব অনার লালগালিচা বিছিয়ে এক অভাবনীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয় রাজধানী টোকিওতে।

শেখ হাসিনার এবারের জাপান সফর অনেকটাই বর্ণাঢ্যময়। অতীতের যেকোনো সফরের চেয়ে এ সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিই গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে। জাপান একটি শান্তিপ্রিয় উন্নত প্রযুক্তির দেশ। দেশটির মানুষও কর্মবীরের মর্যাদায় সিক্ত। জানা গেছে, এ সফরে ৮টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি, শুল্ক, আইসিটি, গণপরিবহন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, গণপরিবহনে মেট্রোরেল বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে দুটি দেশ ঐকমত্য হয়েছে। যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়েছে বর্তমান বাস্তবায়নতায় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, দেশ তত অগ্রসর হবে। প্রযুক্তির ব্যাপকতায় নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। আমরা দেখছি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের ভেতর দিয়ে কৃষি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় দক্ষতা অর্জন সম্ভব হবে। বাংলাদেশ জাহাজ শিল্পে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। গণপরিবহনে বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। এসব সেক্টরে জাপানি সহযোগিতা নিশ্চিত হলে উভয় দেশই বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে। আশার বিষয় হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো সরকারিভাবে আমাদের দেশে জাপানের বিনিয়োগের পরিবেশকে আরও সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে জাপানি বেসরকারি বিনিয়োগও উৎসাহিত হবে। প্রধানমন্ত্রী এবারের সফরে জাপানের উদ্যোক্তা শিল্পপতি তথা বিনিয়োগকারীদের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেছেন। যে বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক এবং বাণিজ্যিক পরিবেশের চিত্র তুলে ধরেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে যদি রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকে, তবে সেখানে কখনও বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় না। প্রধানমন্ত্রী সেদিক থেকে যথেষ্ট কমিটেড। যে কারণে জাপানিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে অধিক উৎসাহী হয়ে উঠেছে। উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে, গত ২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধীনে ৪০টি কোম্পানি প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এ ৪০টি কোম্পানির মধ্যে ৩০টিই জাপানি, বাকি ১০টি অন্যান্য দেশের। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি পুরোপুরি চালু হলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ আসবে; যেখানে প্রায় ১ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। প্রধানমন্ত্রী সফরকে কেন্দ্র করে আশা করা হচ্ছে খুব শিগগির বাংলাদেশে আরও ১০০টি জাপানি কোম্পানি ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে আসছে- যাতে আরও ১ লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাই সফরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণময়।

বর্তমানে বিশ্বে চলছে অর্থনীতির কূটনীতি। অর্থনীতির কূটনীতিনির্ভর রাজনীতিই মানুষের কল্যাণময় জগৎ সৃষ্টি করতে পারে। শেখ হাসিনা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই উন্নয়নের গণতন্ত্রকে বিকশিত করছেন। যুগ বদলে গেছে, বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির দিন শেষ। উল্লেখ্য, জাপান সফরের তৃতীয় দিনে জাপানি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ৫০ বছরের ঈর্ষণীয় সাফল্যের কথা উল্লেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সাফল্য আগামী ৫০ বছরের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ জাপানি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্ট পাবলিক-প্রাইভেট ইকোনমিক ডায়ালগ (পিপিইডি) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে পিপিইডির পঞ্চম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিপিইডির মাধ্যমে জাপানি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের যোগাযোগের একটি ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রতিযোগিতামূলক খরচ, প্রচুর মানবসম্পদ, উচ্চ ক্রয়ক্ষমতা সম্পৃক্ত বিশাল দেশীয় ভোক্তা বাজার এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত লাভজনক অবস্থান হিসেবে দ্রুত আবির্ভূত হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে জাপানি ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবেন এবং দু’দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে।