পুনঃস্থাপন করা হোক ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস লাইন
আর কে চৌধুরী
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীজুড়ে যে গ্যাস পরিবহন ও সঞ্চালন লাইনের নেটওয়ার্ক রয়েছে তার বেশিরভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বশেষ গত সোমবার (২৪ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় লাইনের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসা গ্যাসের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। গন্ধ ছড়িয়ে পড়া এলাকাগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কোনো কারণে আগুনের সংস্পর্শ পেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা ছিল। তিতাস কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গ্যাস লিকেজের এমন ঘটনা আমাদের শঙ্কিত করে।
বর্তমানে তিতাস গ্যাসের বেশিরভাগ পাইপলাইনের ‘টেকনিক্যাল লাইফ’ শেষ হয়ে গেছে। কমপক্ষে ২০ বছর আগে এসব পাইপলাইনের মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপের বিভিন্ন স্থানের ছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে গ্যাস বের হয়ে আশপাশের শূন্যস্থানে জমা হয়। আগুন, উচ্চতাপ বা অন্য কোনো গ্যাসের সংস্পর্শে এলেই ঘটে বিস্ফোরণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির ক্ষার ও লবণের কারণে পাইপগুলো ক্ষয় হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় মরিচা ধরে পাইপ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তৈরি হয়েছে হাজার হাজার ছিদ্র। এসব ছিদ্রপথে প্রায়ই গ্যাস বের হচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে ফুটো করে গ্যাস সংযোগ দেয়ায় বেশিরভাগ লাইনের অবস্থা জরাজীর্ণ। এর বাইরে প্রায় ৫০ হাজার সংযোগ রয়েছে যেগুলো সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করা রয়েছে। কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও গ্রাহক আঙিনায় রাইজার রয়ে গেছে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ১৯৭০ সালে যেসব পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছিল তার টেকিনিক্যাল লাইফ ধরা হয়েছিল ৩০-৩৫ বছর। সেই হিসাবে তিতাসের ৬০ শতাংশের বেশি পাইপলাইনের বয়স ৫৫-৬০ বছরের অধিক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে তিতাস গ্যাসের পুরো পাইপলাইন সংস্কারের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও পাইপলাইন সংস্কার ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি, যা দুঃখজনক। অবিলম্বে এসব পাইপলাইন সংস্কার ও প্রতিস্থাপনসহ অবৈধ লাইন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার ২১টি এলাকার পাইপলাইন বিভিন্ন শিল্পকারখানার লাইনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এসব এলাকার পাইপে গ্যাসের চাপ থাকে সাধারণত ৫-৭ পিএসআই। ঈদের ছুটির কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় ক্রমান্বয়ে গ্যাসের চাপ বেড়ে ৩০ পিএসআইর বেশি উঠে যায়। যে কারণে পাইপলাইনের ছিদ্রপথে গ্যাস বের হয়ে পুরো এলাকায় গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। রাজধানীসহ সারাদেশে তিতাসের পাইপলাইনে লাখ লাখ ছিদ্র আছে। জননিরাপত্তার স্বার্থে ও বড় দুর্ঘটনা রোধে যত দ্রুত সম্ভব গ্যাস সরবরাহের এসব পাইপলাইন ঝুঁকিমুক্ত করতেই হবে।
শহরের বাসাবাড়িতে রান্নাবান্নার কাজে এখনও মানুষ প্রধানত গ্যাসনির্ভর। কিন্তু সেই গ্যাস নিয়েও মানুষের যেন দুর্ভোগের অন্ত নেই। বিশেষ করে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ এতটাই কম থাকে যে অনেক সময় রান্নাই করা যায় না। আবার প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
ঢাকার বেশিরভাগ পাইপলাইন মেয়াদোত্তীর্ণ। অসংখ্য ছিদ্র তৈরি হয়েছে। পাইপলাইন পুনঃস্থাপন করা না হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যাবে।
তিতাসের ১৩ হাজার ১৩৮ কিলোমিটার পাইপলাইনের মধ্যে ঢাকায় আছে, সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি পাইপলাইন। এখন এর ৬০ শতাংশই অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। দ্রুততম সময়ে সেগুলো পুনঃস্থাপন করা প্রয়োজন। জানা যায়, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পুরোনো সব লাইন পরিবর্তন করে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের জন্য একটি মেগাপ্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পাঠানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগির প্রকল্পটি অনুমোদন পাবে এবং পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু করা যাবে। আমরাও চাই অত্যন্ত জনগুরুত্বসম্পন্ন এ কাজটি অতিদ্রুত শুরু করা হোক।
রাজধানীতে অনেকবার গ্যাস লাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ব্যবহারকারীরা সচেতন হলে এবং অবৈধ ও ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস লাইন-সিলিন্ডারের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কঠোর হলে অনাকাঙ্ক্ষিত হতাহতের ঘটনা এড়ানো যেত।
বিস্ফোরণের ঘটনার পর সংযোগ-সিলিন্ডারের ত্রুটির কারণ খুঁজে বের করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। গ্যাসের মতো অপরিহার্য জ্বালানির মজুদ আমাদের অফুরন্ত তো নয়-ই, একেবারেই সীমিত। এরই মধ্যে শিল্প ও গৃহস্থালি চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি শুরু করতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক, এ অবস্থার মধ্যেও একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর গ্যাস অপচয়-চুরির পথ উন্মোচন করে দেয়া বন্ধ হয়নি। দেশের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে এ খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া গেলে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় হতাহত কমানো এবং রাষ্ট্রের অপরিহার্য সম্পদটির অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ