শেয়ারবাজার

শেয়ারবাজারে সফলতা অর্জনের কোনো জাদুকরি সমীকরণ নেই

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক, [email protected]

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বলা হয়ে থাকে, শেয়ারবাজার হলো ষাঁড়-ভল্লুকের খেলা। যেনতেন দুর্বল প্রাণীর এখানে কোনো ভূমিকা নেই। তবে এ খেলাটি কিন্তু উপভোগ্য করে তোলে বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজারে ষাঁড় না ভল্লুক- কে আধিপত্য বিস্তার করবে শেষ বিচারে তা আবার নির্ভর করে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর। তবে আমাদের দেশে করোনার আগে প্রায় এক দশক ধরে অর্থনীতিতে তেজিবাঘের গর্জন থাকলেও শেয়ারবাজারে ছিল সর্বদা ভল্লুকের শ্লথগতি। আর এখনকার অর্থনীতি বিবেচনায়, মূল্যস্ফীতির চাপে সেই বাঘের গর্জন যখন ম্রিয়মাণ, তখন এই ষাঁড়-ভল্লুকের কথা বলার আর নতুন কী? ষাঁড়ের তো কথাই নেই। আর বাজারে যে ভল্লুকের আচরণ, তা শুধু চুপসেই যায়নি, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দু’দিন পরপর ওই একই সংবাদ- শেয়ারবাজারে লেনদেনে খরা চলছে। প্রাসঙ্গিকতা, গুরুত্ব কিংবা তাৎপর্যের বিবেচনায় সংবাদের তো একটা ন্যূনতম মূল্য থাকা দরকার আছে।

সূর্য পূর্বদিকে ওঠে আর পশ্চিমে অস্ত যায়। এটা যেমন কোনো সংবাদ না, তেমনি আমাদের শেয়ারবাজারে লেনদেনের এ করুণ হাল, বহু দিনের বাস্তবতায় এর সংবাদ মূল্য হারিয়েছে। বরং সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, লেনদন যখন চাঙা হয়, তখন এটি গড়পড়তায় সংবাদ হয়ে ওঠে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ হঠাৎ করে শ্লথ বা বিয়ারিশ বাজারে বুল বা ষাঁড়ের আবির্ভাব বিনিয়োগকারীদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ উদ্রেক করে। কালেভদ্রে বাজারের এই যে ষাঁড়ের আচরণ- তা কি বাজারের নিজস্ব শক্তি? নাকি ষাঁড়টি কৃত্রিমভাবে মোটাতাজাকরণ হয়- তা বিনিয়োগকারীর কাছে দিনদিন স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। তাইতো বাজারে এখন আর আগের মতো কোনো সুসংবাদ বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথাকথিত কোনো পদক্ষেপই বিনিয়োগকারীদের কাছে কলকে পায় না। ফলে বাজারে তৈরি হয়েছে এক দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা।

অনেকের মতে, ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারদরের সর্বনিম্ন মূল্য স্তরই নাকি এ সংকটের মূল কারণ।

তবে এই মতানুসারীদের মনে রাখা দরকার- ফ্লোর প্রাইস যেমন বাজারের গতিশীলতার জন্য ভালো নয়, আবার এ মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস ব্যতিরেকে শেয়ারবাজারে আশাতীত যে গতি, তা যে দুর্গতিতে পরিণত হবে না, ইতিহাস কিন্তু সে কথা বলে না।

গত বছরের ১৩ নভেম্বর সর্বশেষ সূচক ডিএসইএক্স ৬ হাজার ৩০৪ পয়েন্ট ছিল। এরপর থেকে সূচক আর সেই মাইলফলক পার করতে পারেনি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত নভেম্বর থেকে এপ্রিলের এ সময় পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজার ১৭৭ পয়েন্ট থেকে ৬ হাজার ২৯৬ পয়েন্টের মধ্যে ওঠানামা করছে। ওঠানামার ব্যবধান ছিল মাত্র ১১৯ পয়েন্ট। তা শতাংশের হিসাবে ওই সময়ের সর্বশেষ অবস্থান থেকে মাত্র ১ দশমিক ৯২। আর কালের বিবেচনায় প্রায় ৬ মাস এবং ২০১০ সালের ধস-পরবর্তী সময়ে নতুন সূচকের এটি একটি স্থবিরতার রেকর্ডও বটে। এটি সবারই জানা, একবার শেয়ারবাজার ধসের পর স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরত আসতে দীর্ঘসময়ের প্রয়োজন হয়।

১৯৯৬ সালে ধসের পর শেয়ারবাজার স্বাভাবিক হতে প্রায় ৭ বছর অতিবাহিত হয়। আবার বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ধসের ইতিহাস খুঁজলে প্রথমেই বলতে হয় টিউলিপ ম্যানিয়ার কথা, যা ৪ ফেব্রুয়ারি ১৬৩৭ সালে ইউরোপে টিউলিপ ফুলের শেয়ারদরের ধসের মধ্য দিয়ে শেয়ারবাজারের ইতিহাসে প্রথম ধসের সূচনা হয়। এরপর সাউথ সি বাবল, যা ১৭২০ সালের আগস্ট মাসের যুক্তরাজ্যের সাউথ সি কোম্পানির স্টকের দাম বৃদ্ধি দিয়ে শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ধস পূর্ণরূপ ধারণ করে।

আবার আধুনিক কালের অর্থব্যবস্থায়-১৯২৯ সালে ২৪ অক্টোবর আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিটে একটি মহাধস সংঘটিত হয়। যা ‘ব্লাক থার্সডে’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৩২ সালে সূচক প্রায় ১০ বছর আগের অবস্থানে ফিরে যায়। ফলে অর্থনৈতিক মন্দায় প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ আমেরিকান বেকার হয়ে যায়। পুরো অর্থনীতি মন্দাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ১৯ অক্টোবর ১৯৮৭ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় সব প্রধান শেয়ারবাজার ধসের সম্মুখীন হয়। শুরু হয় হংকং থেকে যা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, আমেরিকায়।

এটাকে ‘কালো সোমবার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও ১৩ অক্টোবর ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্টের শেয়ারবাজারে আরেকটি ছোট ধস নামে, শেয়ারবাজার স্বাভাবিক হতে প্রায় এক দশক সময় নেয়। ১৯৯০ সালে জাপানের শেয়ারবাজারে দরের সংশোধন হয়- সূচক প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। এটিও এক দশকের আগেই স্থিতিশীল হয়। অতিসম্প্রতি অতিমারি বা রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বে বৈশ্বিক শেয়ারবাজার অনেকটাই নিচে নেমে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। এভাবেই বহু ধসের সাক্ষী বিশ্ব শেয়ারবাজার। মূলত শেয়ারবাজাররের বৈশিষ্ট্য সারা বিশ্বে একইরকম। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলে। বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ধস হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঠিক ও সময়োপযোগী তদারকির মাধ্যমে তা কাটিয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের শেয়ারবাজারের ধস, দশকের ঘর পেরিয়ে যুগ থেকে মনে হয় অনাদিকালের পথে যাত্রা করেছে। এ যাত্রার শেষ কোথায়?

তা কারও জানা নেই। শেয়ারবাজার ধসের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে অতিমূল্যায়িত শেয়ার সঠিক দরে ফেরত আসে। অনেক সময় এ প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল ধরে চলে। অবশেষে বাজার একটি সর্বনিম্ন বিন্দু স্পর্শ করে। বুদ্ধিমান বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তখন বাজারে ফিরতে শুরু করে।

ভালো মৌলভিত্তি শেয়ার দেখে বিনিয়োগ করে। ধীরে ধীরে বাজার স্বাভাবিক হয়। আমাদের শেয়ারবাজারের সেই সর্বনিম্ন শেষ বিন্দু বা সাপোর্ট লেভেল কোথায়? আর মৌলভিত্তি শেয়ারে বিনিয়োগ- যার মাধ্যমে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর কথা, সে আলোচনায় লজ্জিত হতে হয়। আমাদের শেয়ারবাজারে ভালো-মন্দ শেয়ারের কোনো বাছবিচার নেই, সবই হরেদরে কেনাবেচা হয়। নামিদামি অনেক কোম্পানির শেয়ারদর গত ৭ থেকে ৮ মাস ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, কোনো ক্রেতা নেই। এটি অস্বীকারের উপায় নেই, অনেক কোম্পানির ওপরই অর্থনৈতিক টানাপড়নের প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যেই আবার কিছু ভালো করছে। যা কোম্পানির লাভ লোকসানের হিসাবে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কারও মুনাফা কমেছে বা বেড়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই এসব শেয়ারদরে প্রভাব ফেলছে না।

মূলধনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ কোম্পানির শেয়ারের ৯টির দরের কোনো পরিবর্তন নেই। বাজারের যখন এই হালহকিকত, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়- বাজারে কোনো সমস্যা নেই, সব সমস্যাই সমাধান করা হয়েছে, এখন বিনিয়োগকারীদের কাজ বাজারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটি প্রকারান্তরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অসহায়ত্বেরই প্রকাশ। তাহলে ক্ষুদ্র বা মাঝারি বিনিয়োগকারীদের গত্যন্তর কোথায়? তাই তো নিরুপায় বিনিয়োগকারীরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। আবার দফায় দফায় বিভিন্ন দফা নিয়ে শেয়ারবাজারের অস্থিরতা নিরসনে রাস্তায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছেন।

তবে হ্যাঁ, সংস্থাটি ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজারের পতন আটকে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আস্থার যে পতন হয়েছে, সে পথ্য কোথায়? শেয়ারবাজার মানবসমাজ এবং অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রকৃতিতে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। যার বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রয়েছে। রয়েছে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বিভিন্ন কালের মাত্রায় চিন্তা ও যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষমতা। পুঁজি বিনিয়োগের অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে শেয়ারবাজার সবচেয়ে জটিল ও স্পর্শকাতর একটি জায়গা। যেখানে সফলতার জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে, তবে ‘লোভ ও ভয়’ এই দুটির সর্বনাশা প্রভাব থেকে বের হতে পারে না। এই দুটির আবর্তেই সারা জীবন ঘুরপাক খায়।

শেয়ারবাজার সব শ্রেণির বিনিয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি বিশালমাধ্যম। আজকের শেয়ারবাজারের সূচক বা সামষ্টিক যে অবয়ব তা বিনিয়োগকারী বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামষ্টিক ভবিষ্যৎ আশার একটি প্রতিফলন। শেয়ারবাজারে ধস বা মন্দাভাব এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে বাজার কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে। বিনিয়োগকারীরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকনির্দেশনা পান। যা কাজে লাগিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সফলতার সুযোগ থাকে। কিন্তু চিন্তা করার বিষয় হলো- আমরা বিগত বাজার থেকে কি সেই শিক্ষা পেয়েছি? যা পেয়েছি তা বর্তমান বাজার দেখলেই সহজে পরিষ্কার ধারণা লাভ করা যায়। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, আমাদের শেয়ারবাজার কি নিছকই আমাদের দুর্ভাগ্যের একটি পরিণতি? না অন্য কোনো ব্যর্থতা। তা বুঝতে হলে আমাদের কিছু কালচারাল ফ্যাক্টগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। যা তাত্ত্বিকভাবে বললে- সাংস্কৃতিক হাইপোথিসিস থিওরির মধ্যে পড়ে। এটি এমন এক বিষয়, যা নির্দিষ্ট কোনো জাতির সংস্কৃতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ থেকে একটি প্রচলিত ধারণা, কিন্তু প্রমাণিত নয়। তবে এটি তো সত্য, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে স্বভাবগতভাবে পারস্পরিক বিশ্বাস, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, আত্মসম্মানবোধ, মূল্যবোধ বা নৈতিকতার কোনো বালাই নেই।

আরও স্পষ্ট করে বললে, আমাদের কোনো কাজেরই ভালো কোনো নীতিশাস্ত্র নেই, কর্মপরিকল্পনা নেই। আমরা জাতিগতভাবে আর্থিক জ্ঞানশূন্য ও অস্থির মানসিকতার। আমরা সাহস, উদ্যম ও বৈচিত্র্যশূন্য গড়পড়তার হুজুগে বাঙালি। ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি ‘গ্রোথ মিরাকলস’ তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শেয়ারবাজারের মতো স্পর্শকাতর জায়গা অকেজো রয়ে যাচ্ছে। এখানে আমাদের অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার রয়েছে। সর্বপরি বলতে হয়, শেয়ারবাজারে সফলতা অর্জনের কোনো জাদুকরি সমীকরণ নেই। কঠোর পরিশ্রম, জ্ঞান অর্জন, ধৈর্য ধারণ এবং লোভ ও ভয় এর ওপর নিয়ন্ত্রণই হচ্ছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ সাফল্যের মূল উপাদান। যা দ্রুত অর্জন করা কঠিন। কালের পরিক্রমা ও বাজারের সংশ্লিষ্টতা থেকে তা অর্জন করতে হয়।