ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধ জরুরি

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধ জরুরি

থ্যালাসেমিয়ার মতো মারণব্যাধি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতেই প্রতিবছর ৮ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্তস্বল্পতার রোগ। এ রোগে আমাদের রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে যায়। রক্তে লোহিত কণিকার ভেতরে থাকে হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিন আয়রন এবং গ্লোবিন প্রোটিন দ্বারা গঠিত। আমাদের যেটা প্রধান গ্লোবিন সেটা গ্লোবিনের দুই জোড়া চেইন দ্বারা গঠিত-আলফা এবং বিটা। থ্যালাসেমিয়ায় যে সমস্যাটা হয়, তাহলো এ দুই জোড়া গ্লোবিনের যে কোনো এক জোড়ার তৈরি কমে যাওয়া। যাকে আমরা আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া বলি। উভয়েরই কারণ জেনেটিক মিউটেশন। মিউটেশনের কারণে স্বাভাবিকের বাইরে প্রোটিন তৈরি হয়। এটা বিভিন্ন কারণে হয়। আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির পরে কোটি কোটি বছর ধরে এই মিউটেশন হয়ে আসছে। কারণ যাই হোক মিউটেশনের ফলে গ্লোবিন চেইনের তৈরি কমে যায়। একজোড়া চেইনের তৈরি যখন কমে যায়, তখন সঙ্গের অন্য জোড়ার তৈরি বেড়ে যায়। বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক গ্লোবিনের কারণে লোহিত কণিকাটি ভেঙে যায়। ফলে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ এবং হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমে যায়। আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া দেখা যায়। যাদের ক্ষেত্রে সাধারণত : নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন দরকার হয় এবং যাদের অধিকাংশেরই নিয়মিত রক্ত লাগে না আমাদের দেশে thalassaemia major এবং thalassaemia-এর সংখ্যা বেশি।

বংশানুক্রমের ব্যাপার হলো- বাবা-মা দুইজনেই যদি বাহক হয়, তাহলে কিছু সন্তান সুস্থ হবে, আবার কিছু সন্তান রোগী অথবা বাহক হবে। বাবা-মা দুইজনেই যদি রোগী হয়, তাহলে সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার যদি মা-বাবার একজন রোগী হয়, অন্যজন সুস্থ হয়, তাহলে কিছু সন্তান বাহক হবে, কিন্তু সুস্থ হবে। তার মানে হলো রোগটি মা-বাবার থেকেই বাচ্চার মধ্যে সঞ্চালিত (Inherited) হয়। তাই যদি বিবাহ করার আগে রক্তের পরীক্ষা করে নেয়া যায়, যে পাত্র বা পাত্রী কেউই বাহক বা রোগী নয়, তাহলে রোগটি সঞ্চালিত হতে পারবে না। এটা বাচ্চা মায়ের পেটে আসার পরেও নির্ণয় করা যায়, যা ব্যয় সাপেক্ষ। যদি দেখা যায় মায়ের পেটের বাচ্চা আক্রান্ত হয়েছে তাহলে Pregnancy termination ও করা যায়। এক-একাধিক Screening test দ্বারা বাহক বা রোগী শনাক্ত করা যায়।

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের শরীরের রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না। ফলে শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারী অঙ্গ যেমন- প্লীহা, যকৃৎ বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমণ্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারণে শিশুর চেহার বিশেষ রূপ ধারণ করে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বারবার রক্ত নেয়ার একটি বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। ফল স্বরূপ যকৃত বিকল হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্ত দেয়া ছাড়াও জমে যাওয়া আয়রন শরীরের ভেতর থেকে বের করতে হয়। না হলে থ্যালাসেমিয়ায় রোগীরা ৩০-৪০ বছরের বেশি বাঁচে না। এ ধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপি দেয়া হয় অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেয়ার জন্য। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরি চিকিৎসা যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে এর চিকিৎসা সবসময় সফল নাও হতে পারে। এছাড়া জিন থেরাপি এবং স্টেম সেল থেরাপিও থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরি চিকিৎসা।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো প্রতিরোধ। এ ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। না হলে হয়তো ভবিষ্যতে কোনো একদিন দেখা যাবে, বাংলাদেশের সব লোক থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বা রোগী। তখন চিত্রটি কেমন হবে? সেই পরিস্থিতি যাতে আমাদের সম্মুখীন হতে না হয় তাই আমাদের করণীয়।

থ্যালাসেমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এ রোগের দু’জন বাহকের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত এবং প্রতিহত করার মাধ্যমে সমাজে নতুন থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হ্রাস করা যায়। সুতরাং আর দেরি না করে আজই থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় এর জন্য হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষাটি করান এবং আপনার শিশুকে এর অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখুন। এছাড়া এরই মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ যেসব পরিবারে স্বামী বা স্ত্রী দু’জনই এ রোগের বাহক তারা গর্ভস্থ ভ্রুণ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালসেমিয়া শিশু নির্ণয় এবং তা পরিহার করতে পারেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়।

প্রতিরোধের ক্ষেত্রে National ID তৈরির সময় লোকের রক্তে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করা যায়। স্কুলে ভর্তির সময় বাচ্চাদের এবং বাবা-মায়ের পরীক্ষা করা যায় এবং রেকর্ড নথিভুক্ত করা যায়। অনেক রকম Screening test আছে। প্রাথমিক কর্তব্য হলো একটি Screening test ঠিক করা এবং সে পথে আগানো। এক্ষেত্রে সামাজিক বা সরকারি উদ্যোগ দরকার। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে একই বংশের ভাই-বোনের মধ্যে বিভিন্ন কারণে বিবাহের প্রচলন আছে। এটা থ্যালাসেমিয়া বিস্তারের কারণ। সেক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সামজিক সচেতনতা তৈরি করতে পারলে বিস্তারের ব্যাপকতা কমানো সম্ভব। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে রোগী অথবা বাহকের সংখ্যা বাড়ছে। যার চিত্র খুব ভয়াবহ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা হলো রোগীদের চিকিৎসা, পরামর্শ ইত্যাদি। আর বেসরকারি স্বেচ্ছা সংগঠনগুলোর ভূমিকা হওয়া উচিত মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা, যাতে রোগটির বিস্তার রোধ করা যায়। রক্ত সংগ্রহের ব্যাপারেও তাদের ভূমিকা থাকতে পারে- যেমন মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করা। রক্ত সংগ্রহ এবং রক্তদানের কতকগুলো নিয়মকানুন আছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে যা স্পেশালিষ্টদের কাজ। এ ব্যাপারে স্বেচ্ছা সংগঠনগুলো উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারকে পরামর্শ দিতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত