শিক্ষাদীক্ষা

মাধ্যমিক শিক্ষকদের অননুমোদনহীন ছুটিতে থাকা ও মাউশির উদ্যোগ

মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, [email protected]

প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারা দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। যৌক্তিক কারণে শিক্ষকদের মধ্যে দু-একজনকে ছুটিতে থাকতে হলেই নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। হাতেগোনা দু-একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়তো একটু বেশি শিক্ষক আছেন; কিন্তু অধিকাংশ বিদ্যালয়েই কাঁটায় কাঁটায় কিংবা প্রয়োজনের তুলনায় কম শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে আবার কিছু শিক্ষকের অনুমোদনহীন ছুটি কাটানোর প্রবণতা বেড়েছে। এতে একদিকে যেমন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। করোনার পর থেকে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির প্রবণতা বেড়েছে। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চল ও দুর্গম অঞ্চলে এ সমস্যা বেশি। গ্রামাঞ্চল এবং দুর্গম এলাকায় শিক্ষক সংকট রয়েছে প্রবল, শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পিছিয়ে থাকে, তার ওপর কিছু শিক্ষকের অননুমোদিত ছুটি সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। মাউশি মোটামুটিভাবে ২০ হাজারের অধিক (২০ হাজার ৩১৬টি) মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করে। এবার জানুয়ারি মাসে চাঁদপুর, দিনাজপুর, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলের ১০টি বিদ্যালয়ে ঝটিকা পরিদর্শনে যান মাউশির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ সময় ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত পাওয়া যায়, যারা কোন ধরনের অনুমতি ছাড়াই ছুটিতে ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশের ৫৫টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন এসব কর্মকর্তারা। এ সময় ছুটির অনুমোদন ছাড়া বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন ৯৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী। অনুমোদন ব্যতীত ছুটিতে থাকা বেশির ভাগই সহকারী শিক্ষক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান শিক্ষক। এ ছাড়া রয়েছেন সহকারী ইনস্ট্রাক্টরসহ অন্য কর্মচারীরা। অনুপস্থিত এসব শিক্ষকদের মধ্যে দু’জন ছুটি ছাড়াই দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন।

বিদ্যালয়ে আসার সময়সূচি মানার ক্ষেত্রেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের মধ্যে অনীহা দেখা যায়। বেশির ভাগ শিক্ষক তাদের খেয়ালখুশি মতো বিদ্যালয়ে যান। সকাল ১০টার দিকে একটি বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে ২২ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র পাঁচজন বিদ্যালয়ে উপস্থিত। অনেক শিক্ষক পূর্বানুমতি ছাড়াই ছুটি কাটিয়ে থাকেন। এসব বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের নিয়মিত ও দৈনিক উপস্থিতি নীতিমালা আছে। এই নীতিমালা কার্যকরের উদ্যোগ নিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কঠোর নজরদারিসহ মাউশির পর্যবেক্ষণ থাকা পর্যন্ত পুরো চেইনে পরিবর্তন আনতে হবে। উপরোক্ত কারণগুলো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিক পাঠদানকে ব্যাহত করছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এ ঘাটতি পূরণে সরকার রেমিডিয়ালের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে; কিন্তু সেটি এখনও জোরালোভাবে শুরু হয়নি।

শিক্ষকদের এমন অনুপস্থিতি নিয়ে মাউশি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে ঝটিকা পরিদর্শনের সময় যেসব শিক্ষক-কর্মচারী কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের ঢাকায় এসে মাউশিতে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। আবার যেসব শিক্ষক ছুটি ছাড়াই দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের মাউশিতে কারণ দর্শাতে ডাকা হয়েছে। বিনা অনুমতিতে কোনো কর্মকর্তা বা শিক্ষক দেশের বাইরে অবস্থান করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা যেতে পারে। এতে সর্বনিম্ন সাজা বিনা বেতনে ছুটি প্রদান। গুরুদণ্ড হিসেবে চাকরি পর্যন্ত চলে যাওয়ার বিধান রয়েছে। বিদেশে যাওয়া শিক্ষকদের বিষয়ে মাউশিকে না জানানোর কারণে প্রধান শিক্ষকদের আসতে বলা হয়েছে। এসব শিক্ষক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যখন ঢাকায় আসবেন, তখন সময় আর অর্থ দুটোই অপচয় হবে। এই ভোগান্তির বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের পাশাপাশি অন্যরাও সতর্ক হবেন। এর আগে ২০১৯ সালে এমন ঝটিকা পরিদর্শন চালু করা হয়। এতে একসময় অননুমোদিত ছুটি প্রায় শূন্যের ঘরে চলে আসে। করোনার পর আবার শিক্ষকদের মধ্যে অনুপস্থিতির প্রবণতা বেড়েছে। তাই আবার ঝটিকা পরিদর্শন শুরু হয়েছে। শিক্ষকদের সতর্ক করার জন্য বিষয়টি করা হচ্ছে বলে মাউশি সূত্র জানিয়েছে।

আমরা জানি, শিক্ষকদের অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক বেদনা রয়েছে। তারপরও চিন্তা করতে হবে নিজের চাকরিকে নিজেই যদি গুরুত্ব না দেন, মূল্যায়ন না করেন, তাহলে অন্য কেউ মূল্যায়ন করবে না। যেমন, বিনা অনুমতিতে ছুটি নেয়া মানে হচ্ছে, এই পেশায় কোনো জবাবদিহিতা নেই। কারণ এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ ধরনের ধারণা সমাজে ছড়িয়ে পড়লে এরই মধ্যে সমাজের যে অধপতন হয়েছে, সেটি দ্রুত আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বিদেশে যেসব শিক্ষক অবস্থান করছেন, তারাও কোনো ধরনের অনুমতি নেননি- এ বিষয়টি জটিল মনে হয়। এখানে দুটো বিষয় একটি হচ্ছে- প্রধান শিক্ষক কেন জানেন না যে, তার শিক্ষক বিদেশে অবস্থান করছেন।

তাহলে কি প্রধান শিক্ষকও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না? নাকি তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। যারা বিদেশে অবস্থান করছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বিদেশে যেতে হয়। এখানে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন মানে বিশাল এক ঝামেলা, বিশাল এক গ্যাঁরাকল, বিশাল এক বিব্রতকর অবস্থা, বিশলা হয়রানি। কারণ, একজন শিক্ষক কিংবা কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। তিনি অনুমোদন দিতে পারবেন না, পাঠাবেন জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে, তিনিও পারবেন না। এই দরখাস্ত যেতে হবে বিভাগীয় পর্যায় কিংবা মাউশি পর্যন্ত। এর কোনো স্তর পার হওয়াই সহজ নয়। সব কাজ ফেলে রেখে একজন শিক্ষককে ঘুরতে হবে দিনের পর দিন। তারপরও সহজে কাজ হয় না। মাউশি পর্যন্ত ওই দরখাস্ত আসতে হয়তো কয়েকমাস লেগে যাবে। মাউশিতে আসার পর সেটির কোনো হদিস পাওয়া যাবে না। হদিস করতে গেলে দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি করে অর্থ ও সময় অপচয় করে যদিও বা হদিস পাওয়া যায়, তখন আবার আইন জটিলতায় আটকে যায়। এসব করে যেসব শিক্ষক বিদেশে গিয়েছেন, খুব সম্ভব চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন, কারণ চিকিৎসা করানো ছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের সাধারণত দেশের বাইরে যাওয়ার কথা নয়। এতসব জটিলতা এড়ানোর জন্যই হয়তো শিক্ষকরা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে পারেননি। এটি বিষয়টি সহজ করা দরকার। কিন্তু করবে টা কে? এ দায়িত্ব তো কেউ নেবেন না। এসব বিষয় খেয়াল না করে শুধু শিক্ষকদের দোষ দিলেই হবে না।

দেশের অভ্যন্তরে অনুমোদন ছাড়া শিক্ষকদের ছুটিতে যাওয়া শুধু আইনবহির্ভূত কাজ নয়, বরং অনৈতিক কাজ। এটি শিক্ষকদের করা কোনোভাবেই মানায় না। এই পেশা সমাজের অন্য ১০টি পেশা থেকে পুরোপুরি আলাদা। শিক্ষকদের জবাবদিহি করতে হবে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও নিজেদের বিবেকের কাছে। জবাবদিহির এ জায়গাগুলোতে ঘাটতি থাকলে একজন শিক্ষক তার শিক্ষক নামের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলার অবস্থায় পৌঁছাবেন। বিদ্যালয়ে তাদের অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হওয়ার পাশাপাশি লেখাপড়ার উৎসাহে ভাটা পড়ে। শিক্ষকদের অনুপস্থিতির বিষয়টি রাজধানী বা বড় শহরের তুলনায় মফস্বল বা দুর্গম এলাকায় বেশি দেখা যায়, অর্থাৎ যেসব এলাকায় শিক্ষা কর্মকর্তাদের তদারকি কম হয়। তদারকি যেখানে বেশি সেখানকার শিক্ষকরা ঠিকভাবে কাজ করবেন, বাকি এলাকার শিক্ষকরা করবেন না, এটি এই পেশার সঙ্গে মানানসই নয়। এসব এলাকার শিক্ষার্থীরা এমনিতেই ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানে দুর্বল থাকে। সেখানে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি ‘মড়ার উপর খাঁরার ঘা’য়ের মতো অবস্থা। শিক্ষকদের এখানে বেশি পরিশ্রম করার কথা। সেটি না করে তাদের অনুপস্থিতি, অনাগ্রহ এবং অননুমোদিত ছুটি শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ফেলে দেয়। এই মহৎ পেশার প্রতি সমাজের অন্যান্য পেশাজীবীদের বিশ্বাস কমতে থাকে এবং সহজেই অন্য পেশার সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়। অথচ এই পেশার সঙ্গে অন্য কোনো পেশাকে তুলনা করা যাবে না।

শিক্ষাবিদরা শিক্ষকদের অনুমোদনহীন অনুপস্থিতির পেছনে তিনটি মূল কারণের কথা বলেছেন। প্রথমত, অন্য চাকরি না পেয়ে শিক্ষকতায় যারা এসেছেন, তাদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা থাকাটা স্বাভাবিক। তারা শিক্ষকতার জন্য তৈরি থাকেন না। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে তারা ব্যর্থ হন। পেশার ক্ষেত্রে নৈতিক ও বিধিগত দায়িত্ব না থাকায় তারা এসব অনৈতিক কাজ করেন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের বেতনভাতা অনান্য পেশাজীবীদের চেয়ে বেশ কম। যদি শিক্ষকদের সেভাবে সম্মান ও সম্মানী না দেয়া হয়, তাহলে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে আকর্ষণীয় হবে না। আর আকর্ষণীয় না হলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতার প্রতি আকৃষ্ট হবেন না। তৃতীয়ত, মাউশি তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সৎ তদারকি ব্যবস্থা একেবারে দুর্বল। অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক কারণে ও অর্থ দিয়ে চাকরি পান। তাদের নিয়মের অধীনে আনা বেশ কষ্টকর। বিদ্যালয়গুলোতে এখনও সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা নেই। জবাবদিহির চর্চা শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা এখনও তৈরি করতে পারিনি। এখানে সবচেয়ে বড় জবাবদিহিতা হচ্ছে, নিজের বিবেকের কাছে।