ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুস্বাস্থ্যের জন্য পানির জীবাণুঘটিত দূষণ দূর করা প্রয়োজন

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
সুস্বাস্থ্যের জন্য পানির জীবাণুঘটিত দূষণ দূর করা প্রয়োজন

পানি হচ্ছে আমাদের জীবনের অতি প্রয়োজনীয় বস্তু, যার ওপর নির্ভর করছে প্রতিটি শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। সেজন্য এটাকে অনেক সময় মাস্টার সলভেন্ট বলা হয়ে থাকে। আমরা যদি জীবদেহের ক্ষুদ্রতম একক কোষ নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে অতি সহজেই ধারণা করতে পারি যে, গাছপালা, পশুপাখি সবার জীবনেই একটা প্রধান ভূমিকা পালন করে চলছে। কিন্তু যখন প্রাকৃতিক বা মানুষের সৃষ্টির কারণে ঘনত্ব এবং স্বাভাবিক ভৌতিক বা রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন ঘটে, তখন সে আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না বা পান করা যায় না, দূষিত হয়ে যায়। তার মানে পানীয়জল অর্থ হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যহানিকর জীবাণু ও রাসায়নিক পদার্থ থেকে মুক্ত। যদিও রাসায়নিক দিক থেকে প্রকৃত অর্থে বিশুদ্ধ হয় না, কোনো না কোনোভাবে নানা ধরনের গ্যাস বা খনিজ পদার্থ প্রাকৃতিক উপায়ে মিশ্রিত থাকে; কিন্তু এ মিশ্রিত পদার্থ এত কম পরিমাণে থাকে যার জন্য সাধারণ ধর্মের কোনো বিচ্যুতি হয় না এবং পানি পানীয় হিসেবে ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতি হয় না। অন্যদিকে, এ প্রদূষণের পরিমাণ বেশি হলে পানি দূষিত হয় ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে যা সব জীব জগতের ওপর হানিকারক প্রভাব বিস্তার করে। অন্যদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় শহরাঞ্চল বা শহরতলিতে পানীয়জল সরাসরি নদী, সরোবর, সমুদ্র, মহাসমুদ্র প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন পরিস্রাবণের পর সংগ্রহ করা হয়। এসব প্রায়ই বিভিন্ন কারণে দূষিত হয়ে থাকে। জীবাণুজনিত দূষণ একটি প্রধান কারণ। পানীয় জলের এ প্রকার দূষণ মাটিতে বসবাসকারী জীবাণু, বায়ুতে বসবাসকারী জীবাণ–, তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে নির্গত জঞ্জাল দ্বারা হতে পারে। এর মধ্যে প্রথম কারণটা হচ্ছে অন্যতম এবং এর নানা ধরনের সংক্রামক রোগের জীবাণুগুলো কোনো না কোনো উপায়ে পানীয়জলে মিশে যায়। মানুষের যেসব রোগ-জীবাণু প্রায়ই পানিকে সংক্রামিত করে তার মধ্যে টাইফয়েড, পেরাটাইফয়েড, জন্ডিস, পলিওমাইলেটিস, ভাইরেল হেপাটাইটিস ইত্যাদি প্রধান। তাছাড়া, মাটি ও বায়ুতে কয়েক ধরনের জীবাণু থাকে বিশেষ করে গাছপালা, পশু-পাখিদের বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে।

পানিতে রোগ-জীবাণুর পরিস্থিতিনির্ভর করে মূলত দ্রবীভূত খাদ্যদ্রব্য, জীবাণুনাশক জলীয় পরিবেশ, অন্য জীবাণুদের সংখ্যা ও প্রকৃতির ওপর। কম গভীরতাসম্পন্ন জলাশয়ে খাদ্যবস্তুর প্রাচুর্য্য থাকার ফলে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু পাওয়া যায়। প্রবহমান নদী ও অন্য জলাশয়ের নানা স্থানে জীবাণু সমস্যার প্রকৃতিও বিভিন্ন ধরনের। নোংরা বিভিন্ন বস্তু থাকা নালাগুলোতে সংক্রামক জীবাণুর সংখ্যা থাকে বেশি, সেগুলো নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এ পানি কতটুকু নিরাপদ মানুষের ব্যবহারের পক্ষে। এর পরিমাপ নির্ধারণ করা হয় বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড বা বিওডির দ্বারা। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের নোংরা পদার্থকে পচিয়ে নষ্ট করে দেয়ার জন্য বায়ুজীবী জীবাণুর যে পরিমাণ দ্রবীভূত অক্সিজেন যখন তুলনামূলকভাবে কম থাকে তখন দূষিত বলা হয়। অর্থাৎ বিওডি-এর পরিমাণ নির্ভর করছে বর্জ্য পদার্থের উপর। বর্জ্য পদার্থ বেশি হলে বিওডির মাত্রা বাড়বে এবং মিশ্রিত অক্সিজেনের মাত্রা কমবে।

দূষিত পানির প্রধান শ্রেণিভুক্ত জীবাণুগুলো হলো শৈবাল, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া ইত্যাদি। এগুলো বিভিন্নভাবে পচন ঘটায়। এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া অতি অল্প পরিমাণে খাদ্যবস্তুর উপস্থিতিতেই সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে এবং জৈব পদার্থকে বিয়োজিত করে, পরিশেষে বিভিন্ন গ্যাস যেমন- কার্বন ডাই-অক্সসাইডের পরিবর্তন ঘটায় এবং জীবাণুর বিভিন্ন ধরনের শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটায় ও ব্যবহারের আযোগ্য করে। অন্য জীবাণু যেমন- শৈবাল, প্রটোজোয়া, ছত্রাক এগুলো বিভিন্ন উপায়ে স্বাদ ও গন্ধের পরিবর্তন ঘটায় ও ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলে। পানি দিয়ে যেসব মারাত্মক রোগ-জীবাণুবাহিত হয়, তাদের মধ্যে আমাশয়ের সাইজোলা ডিসেনট্রি, গ্যাসট্রোএনটেরাইটিসের সালমনেলা টাইফিমুরিয়াম, কলেরা রোগের ভিব্রিওকোলেরি, প্যারাটাইফয়েডের সালমনেলা প্যারাটাইফি, ইনফেনটাইল ডায়রিয়ার ই-কলাই ইত্যাদি অন্যতম। এখন আমরা যদি এ অঞ্চলের পানীয় প্রদূষণ ও রোগ-জীবাণু বিস্তার সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করি, তাহলে দেখব যে বহুসংখ্যক সংক্রমিত রোগ এ দূষিত পানির মধ্যে দিয়ে বাহিত হচ্ছে। এদের মধ্যে টাইফয়েড, বেসিলারি ডাইসেন্টিত্থ, অ্যামিবিক ডাইসেন্টিত্থ, অ্যামিবিক ডাইসেন্টত্থ, জিয়ারডিয়াসিস, কলেরা, গ্যাসট্রোএনটেরাইটিস প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।

পানীয় জলের দূষণের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে জীবের রেচন পদার্থ, যা নানা ধরনের জীবাণুঘটিত রোগ সৃষ্টি করে। কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া যেমন- কোলিফরম ব্যাকটেরিয়া, স্টেত্থপটোকক্কাই এবং ক্লসট্রিডিয়মি নানাভাবে মিশে যায়। এ জাতীয় কোনো জীবাণুর উপস্থিতি ব্যবহারের অনুপযোগী করে তোলে। তাই যে কোনো উপায়ে এ জাতীয় জীবাণুকে পানি থেকে বাদ দেয়া বা ধ্বংস করা দরকার। বর্তমানে পানীয় জলের বিশুদ্ধীকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির প্রচলন আছে। সাধারণত লেকটাসযুক্ত জীবাণু খাদ্য মাধ্যমে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতাতে অম্লত্ব ও গ্যাস উৎপাদন দেখে এবং দণ্ডাকৃতি, পোরবিহীন, ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখে দূষণ নির্ণয় করা হয়। বিশুদ্ধীকরণের কিছু কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে তুঁতে বা কপারসালফেট ব্যবহার করে শৈবাল গঠিত দূষণ রোধ করা যায়। অনেক সময় সোডিয়াম বা ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডমিশ্রিত করে বিশুদ্ধকরণ করা যায়। এটা যদিও একটু বেশি ব্যয় সাপেক্ষ, তবে স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। সাধারণত বর্ষার দিনে রং একটু ঘোলাটে থাকে, তখন ফিটকিরি বা অ্যালুমিনিয়াম সালফেট ব্যবহার করা উচিত। জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ এর বিশুদ্ধীকরণের প্রধানত তিনটি ধাপ যেমন- সেডিম্যানটেশন, ফিলট্রেশন এবং ক্লোরিনেশন। দৈনন্দিন জীবনে যেহেতু পরিবেশে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ-জীবাণু থাকে এবং সেখানে একটা বাহক হিসেবে কাজ করে, তাই এ পদ্ধতিগুলোর কিছু কিছু নবীকরণ দরকার। যেমন- পরিস্রবণ বা ফিলট্রেশন, বর্তমানে বিভিন্ন নতুন পরিস্রাবক বা ফিলটার আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো শহরাঞ্চল বা শহরতলির পানি সরবরাহ কেন্দ্রে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং নানা ধরনের জীবনঘাতী জীবাণুঘটিত রোগের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তারপর ক্লোরিনেশনও খুব ভালো করে করা উচিত, যাতে কোনো ধরনের জীবাণু জীবিত থাকতে না পারে।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের সর্বাধিক প্রদূষিত নদীগুলো হচ্ছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, সুরমা প্রভৃতি এবং এর নানারকম রাসায়নিক পদার্থ থাকে যেমন- কেডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, লেড, মারকারি, আর্সেনিক ও অল্পসংখ্যক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। এ রাসায়নিক পদার্থ অথবা তেজস্ক্রিয় পদার্থ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে এমনকি ক্যান্সারের মতো জীবনঘাতী রোগেরও সৃষ্টি করতে পারে।

পানি প্রদূষণের প্রতিকার ও প্রস্তাব পানীয় জলের দূষণের নানা উপায়ে প্রতিকার করা যায়। যেমন-

১. ধৌতাগার, শৌচাগার ও স্নানাগারের বিভিন্ন উৎসের (নদী-নালা, পুকুর, ঝরনার) সঙ্গে মেশার আগে বৈজ্ঞানিক উপায়ে জীবাণুমুক্ত করা দরকার। ২. বর্ষাকালে ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলে নানারকম জীবাণু সংখ্যা বাড়তে পারে, তাই পরিমাণ মতো ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা প্রয়োজন। ৩. শহরের নানা ধরনের জঞ্জাল, শিল্পজাত বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি সরাসরি পানির সঙ্গে মিশতে না দেয়া এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিশোধন করা উচিত। ৪. বিভিন্ন পয়ঃপ্রণালির ব্যবহৃত পানি সাইক্লিং ও রিসাইক্লিং উপায়ে পরিশোধন করা উচিত। ৫. নানা ধরনের সংক্রামক জীবাণু যেমন কলসট্রিডিয়াম, মাইক্রোকক্কাস, র‌্যাকটোবেসিলাস, স্ট্রেপ্টোকক্কাস ও বিভিন্ন এন্টারোব্যাকটেরিয়া নানা উপায়ে পানিতে সংক্রামিত হয়, তাই বর্জ্য পদার্থের শোধন ব্যবস্থা ও পানি শুদ্ধ রাখার জন্য ময়লার বিজ্ঞানসম্মত অপসারণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। ৬. কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিকারক ধাতু ও রসায়ন পদার্থের ব্যবহার কমানো এবং প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের বাধা নিষেধ প্রণয়ন দরকার। ৭. শহরাঞ্চলের নালাগুলোকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যাপকভাবে পুনর্গঠন করা এবং এক একটা নির্দিষ্ট স্থানে শৌচাগার, ধৌতাগার স্থাপন করা দরকার। ৮. যেহেতু এ অঞ্চলের পানীয় জলের প্রধান উৎস হচ্ছে, নদী তাই বিভিন্ন উপায়ে এর প্রদূষণ কঠোর হস্তে রোধ করা প্রয়োজন। যে স্থান থেকে পানীয়জল সরবরাহের জন্য কাঁচা পানি তোলা হয়, সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো ধরনের নোংরা জঞ্জালবাহী নালা বা উপনদীগুলোর যোগাযোগ ছিন্ন করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যদিকে আশপাশে বসবাসকারী, শহরবাসীকে পানীয় প্রদূষণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা দরকার। ৯. সবশেষে যে প্রতিকারের পরামর্শটা দেওয়া উচিত সেটা হলো, এ ধরনের যে কোনো পানীয় জলের প্রদূষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা কারণ আমরাই অনেক সময় অজ্ঞাতসারে বৃহত্তর প্রদূষকের কাজ করে থাকি।

সবশেষে, একটা কথা বলা যায় যে আমরা পানিসম্পদে ধনী এ বিষয়ে যদিও কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এ সম্পদও তো অসীম নয়, তার সঙ্গে আছে আরও অনেক ধরনের জোগান। যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বর্তমান কালের শিল্পোদোগের ব্যাপক প্রসার। সে জন্য পানির প্রয়োজনটাও অনেক বেশি। কিন্তু এখনও যদি এ পরিবেশের ভারসাম্যকে রক্ষা করার কাজে লাগা না যায়, যদি আমন্ত্রণ করি সে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তবে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাব, এক বিভীষিকাপূর্ণ জীবন, যেখানে থাকবে শুধু নবজাতকের কান্না এবং বার্ধক্যের আর্তনাদ। তাই অত্যন্ত বিচক্ষণ দৃষ্টিতে দেখে মানুষকে সচেতন করে আমাদের এ সংকটের মোকাবিলা করা দরকার, অন্তত প্রাথমিক পদক্ষেপটুকু শুরু করা বিশেষ প্রয়োজন ঠিক এখন এ মুহূর্ত থেকেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত