ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের কড়চা

প্রশান্ত মহাসাগর দখল প্রতিযোগিতায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
প্রশান্ত মহাসাগর দখল প্রতিযোগিতায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র

গত অক্টোবর ২০২২ ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর সম্মেলন জি-২০ উপলক্ষ্যে একটি অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সেটি হচ্ছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের দীর্ঘ বৈঠক। বিশ্ব দুই নেতার হাস্যজ্জ্বোল করমর্দনের ছবি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গভীর বিভক্তি সত্ত্বেও এমন বৈঠক বিশ্ববাসী ইতিবাচক হিসেবে চিন্তা করেছিল। সম্মেলনের প্রাক্কালে প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে মতপার্থক্য ভুলে ঘন ঘন যোগাযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুই নেতা। বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম শি জিন পিং-এর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে দুই সুপার পাওয়ারের দৃশ্যমান অবনতিকালে এমন বৈঠকে উন্নতির আভাস মিলে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি হয়েছে। কেননা, সম্প্রতি বিভিন্ন ইস্যুতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব বেড়েই চলছে। দুটি দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশ্বের ছোট দেশগুলোকে নিজ দলভুক্ত করতে নানারকম ফন্দিফিকির করছে। নতুন খেলায় মেতে উঠেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং খুবই ঠান্ডা মাথার একজন খেলোয়াড়। তিনি প্রায়ই সহজ সরল ভাষায় বলে থাকেন, ‘চীনের শুধু চাওয়া এমন একটি স্থিতিশীল ও উন্নত বহুমুখী বিশ্ব, যেখানে বিভিন্ন দেশগুলো বাইরের কোন হুমকি-ধমকির তোয়াক্কা না করে নিজ নিজ নিয়ম কানুন অনুযায়ী চলবে এবং যে বিশ্ব হবে পশ্চিমাদের বেঁধে দেয়া সংজ্ঞার ‘সার্বজনীন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।’

শি জিন পিং এসব কথা মুখে বললেও বাস্তবে চীন বৈশ্বিক নেতৃত্বে নিজেকে বিকশিত করতে মরিয়া। পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন শি জিন পিং কৌশলগত মাস্টারপ্ল্যানের ক্ষেত্রে খুবই প্রতিভাবান ও মেধাবী। কিন্তু আদতে ‘শি, সে ধরনের প্রতিভাধর নন। তিনি মাও সে তুং হতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেছেন। শি জিন পিং-এর নীতিগুলো বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণকে প্রসারিত করে চীনের অর্থনৈতিক মন্দা আরও গভীরতর করছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে অদূরদর্শী লকডাউন এবং আবাসন বাজারের ঋণ সংকট এ সবই তিনি নিজের হাতেই সৃষ্ট করেছেন। শি একজন সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ। তিনি সবসময় নিজের ক্ষমতাকে কীভাবে প্রসারিত করা যায় সেই চিন্তায় মগ্ন থাকেন। তিনি সম্প্রতিকালে ‘সিকিউরিটাইজেশন’ বা ‘সুরক্ষাবাদ’ বলে যে নতুন তত্ত্ব হাজির করেছেন সেটি তার দলের এবং নিজের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আধিপাত্যবাদ ধরে রাখার কৌশল। এ কৌশলের অংশ হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগর দখলের পাঁয়তারা করছেন। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দখলদারিত্বে মুন্সিয়ানা দেখাচ্ছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান দখলদারি প্রতিযোগিতা শীতল যুদ্ধের পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকাংশ এলাকাকে চীন নিজের সার্বভৌমত্ব দাবি করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে আসছে। প্রতিবেশিদের কোণঠাসা করাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। এতে গোটা অঞ্চলের নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা, বিতর্কিত দ্বীপের মালিকানা ও জ্বালানি সংস্থান নিয়ে দ্বন্দ্ব উসকে দিয়েছে। এদিকে তাইওয়ানকে ক্রমাগত ভীতি প্রদর্শন বাংলাদেশে একচেটিয়া বাণিজ্যিক ও ঠিকাদারি সম্প্রসারণবাদ, অন্যদিকে বেইজিংয়ের বিশাল সামরিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, মহামারিকালে অন্যদের সহযোগিতা না দেয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে সমর্থন দেয়া চীনের অহঙ্কারি ও আধিপত্যবাদী আচরণকে স্পষ্ট করেছে। শি জিন পিং এর আক্রমণাত্মক কূটনীতিও দৃশ্যমান। চীনের যুদ্ধংদেহী ভাব সারাবিশ্বে কূটনীতিকদের মাধ্যমে প্রকটিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে জো-বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর শি তার কূটনৈতিকদের চড়াগলাকে খানিকটা নমনীয় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রেখেছেন অদ্যবধি। ম্যানিলায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত তাইওয়ানে কর্মরত ফিলিপিনো কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে দৃশ্যত: যে হুমকি দিয়েছেন তাকে সেই আক্রমণাত্মক নীতির অংশ হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সঙ্গে সাম্প্রতিককালে যে সামরিক চুক্তি করেছে, সেই চুক্তির শর্তে যুক্তরাষ্ট্র এখন ফিলিপাইনে চারটি সামরিক ঘাটি স্থাপন করতে পারবে। এটি চীনের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের আগ্রাসী নীতিকে ফিলিপাইনও ভীতসন্ত্রস্ত, যে জন্য তিনি একটি ভারসাম্য নীতি অবলম্বন করতে চান। এর অংশ হিসেবে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট মার্কোস ফার্দিনান্দ গত জানুয়ারি ২০২৩ চীন সফর করেন। সফর কালে বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। আসলে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঝগড়া আধিপত্যবাদের প্রতিযোগিতা-এর কোনো সারবেত্তা নেই। দুই শিশুর ঝগড়ার সঙ্গেই এর তুলনা চলে। দুই শিশুর এই ঝগড়ায় বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন।

যাহোক বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রশান্ত মহাসাগর দখল প্রতিযোগিতাকে সামনে রেখে ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের সামরিক সম্প্রসারণবাদ ঠৈকাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা দান পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাধা দানের অংশ হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাকে সামনে নিয়ে আশা হয়েছে। ভূরাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিকের ধারণা বিকশিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সন্ধি স্থাপনে এগিয়ে আসছে। ইন্দো-প্যাসিফিক হচ্ছে- ভারত-প্রশান্ত, কখনও কখনও ইন্দো-প্যাসিফিক, ইন্দো ওয়েস্ট প্যাসিফিক এশিয়া নামে পরিচিত। এটি হচ্ছে পৃথিবীর সমুদ্রাঞ্চলের একটি জৈব ভৌগলিক অঞ্চল, যা ভারত মহাসাগরের গ্রীষ্ম মণ্ডলীয় জল, পশ্চিম ও মধ্যপ্রশান্ত মহাসাগর এবং সমুদ্রকে সংযুক্ত করে। আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর গ্রীষ্ম মণ্ডলীয় পূর্ব-প্রশান্ত মহাসাগরকে অন্তর্ভুক্ত করে না, এটি একটি স্বতন্ত্র্য সামুদ্রিক অঞ্চল। ভারত-প্রশান্ত বা ইন্দো-প্যাসিফিক শব্দটি বিশেষত : সামুদ্রিক জীববিদ্যা, ইচথিওলজি এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে উপযোগি, যেহেতু অনেক সামুদ্রিক বাসস্থান মাদাগাস্কার থেকে জাপান এবং ওশেনিয়ার সঙ্গে ক্রমাগত সংযুক্ত রয়েছে, সেই পরিসরে বেশ কয়েকটি প্রজাতি দেখা যায়, কিন্তু অতলান্ত মহাসাগরে পাওয়া যায় না।

এ অঞ্চলে উচ্চ প্রজাতির সমৃদ্ধি লক্ষণীয়। বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রজাতির সমৃদ্ধি প্রবাল ত্রিভুজের হৃদয়ে দেখা যায়; এ সব প্রজাতির সমৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য গ্রেডিয়েন্ট বাইরের দিকে বিকিরণ করে। পশ্চিমা সাগরের অতলান্তের প্রায় ৫০ প্রজাতির তুলনায় এ অঞ্চলে ৩ হাজার প্রজাতির মাছ রয়েছে, যার তুলনায় পরবর্তী সমৃদ্ধ সামুদ্রিক অঞ্চল, পশ্চিম আটলান্টিকের প্রায় ১২০০টি এবং রিফ বিল্ডিং প্রবালের প্রায় ৫০০ প্রজাতি রয়েছে। শব্দটি প্রথমে সমুদ্রবিদ্যা এবং ভূরাজনীতি একাডেমিক ব্যবহারে আবির্ভুত হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে ‘ভারত-প্রশান্ত, ধারণাটি ওয়েইমার জার্মানিতে প্রচারিত হয়েছিল এবং এটিকে কেন্দ্র করে আন্তযুদ্ধ জাপানে ছড়িয়ে পড়েছিল। জার্মান রাজনৈতিক সমুদ্র বিজ্ঞানীরা ভারত-প্রশান্ত, কল্পনা করেছিলেন যেটিতে ঔপনিবেশিক বিরোধী ভারত এবং প্রজাতন্ত্র চীন জার্মান মিত্র হিসেবে “ইউরো-আমেরিকা”-এর বিরুদ্ধে থাকবে বলে ধারণা ছিল। ২০১০-এর শেষ দিকে ‘ভারত-প্রশান্ত, শব্দটি ভূরাজনৈতিক আলোচনায় ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চর্তুপাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপের সঙ্গে এর একটি ‘সিম্বিওটিক লিঙ্ক, রয়েছে। উল্লেখ্য, চর্তুপাক্ষিক নিরাপত্তা বা ‘কোয়াড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক সংলাপের ফোরাম। এটির যুক্তিতে বলা হয়েছে যে, কোয়াডের ধারণাটি জনপ্রিয় ‘মানসিক মানচিত্র’ পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে সেই সঙ্গে বিশ্বকে কৌশলগত দিক থেকে বোঝার সুযোগ তৈরি হবে। ভারত-প্রশান্ত ও কোয়াড পরিপূরক।

বিশ্ব মানচিত্রে চীন-যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তির দেশ হিসেবে চিহ্নিত। উভয়ে বিশ্ব মুরুব্বিয়ানার দায়িত্ব নেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ মুহূর্তে অন্য পরাশক্তি রাশিয়া যুদ্ধে ব্যস্ত রয়েছে। প্রভাবশালী নেতা ঘর সামলাতে গিয়ে ঘুম হারা করে ফেলেছে। পুতিনের নিজস্ব বাহিনীর মধ্যেও অসন্তোষ বিরাজ করছে। পুতিন অনেকটাই দুর্দশাগ্রস্ত, ফলে অন্যদিকে নজর দেয়ার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের মাতাব্বরির ছড়ির আঘাত লাগছে ছোট ছোট দেশগুলোতে। কৌশল পাল্টিয়ে সাগর দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কারণ স্থল সম্পদের ত্রাহি অবস্থায় উভয় শক্তির অর্থনীতি মন্দার দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে, এখন দরকার সাগর সম্পদের। প্রশান্ত মহাসাগরের সম্পদ করায়ত্ত্ব করতে পারলে- নিজ নিজ দেশের মানুষের কাছে মুখ উজ্জ্বল হবে এবং নেতৃত্বের সফলতা প্রমাণ হবে। এদিকে দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জো-বাইডেনের আপাত দৃষ্টিতে সাফল্য থাকলেও বেইজিংয়ের প্রভাব বিস্তার নিয়ে ছোট দেশগুলোর মধ্যে (ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান) যে উদ্বেগ রয়েছে তা নিরসনের উপায় খুঁজতে হবে বাইডেনকে। ঐতিহ্যগতভাবেই ছোট ছোট অনেক দেশ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো জোট গড়েনি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এসব দেশের নাগরিকরা দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের মাঝখানে পরে চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার আশঙ্কা করছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত