ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফুটবলে দুর্দশা কাটবে কবে?

কে এম মাসুম বিল্লাহ, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
ফুটবলে দুর্দশা কাটবে কবে?

পৃথিবীর বুকে সিসেলস নামে একটি জাতি যে ফুটবল খেলে, সেটা কতজনই বা জানে? হয়তো গুটি কয়েকজন মানুষই শুধু জানে। অথচ অপরিচিত সিসেলসের এ দলটির কাছেই সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে নিজেদের ঘরের মাঠে হেরেছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। আমাদের কি স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল? আমাদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল ২০২২ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার। কাতারের দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে ২০২২ সালে যখন মেসি শিরোপাটা হাতে উঁচিয়ে ধরলেন, কোটি কোটি আর্জেন্টাইনদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছিল কোটি বাঙালি! অথচ আমাদেরও স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, যিনি স্বপ্ন দেখেয়েছিলেন তার নাম সালাউদ্দিন! হুম, তিনি বাফুফের ১৫ বছর ধরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন। যার দায়িত্ব নেয়ার সময়ও বাংলাদেশের ফুটবল র‍্যাংকিং ১৪০-এর ঘরে, অথচ এখন সেটা নামতে নামতে ১৯০ এরও পরে (১৯২)। আর কত নিচে নামা সম্ভব! ২০৮ হতে আর হয়তো সময় লাগবে না। ভুটানের কাছে সেই লজ্জাজনক হারের পর যেনো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে দেশের ফুটবল! অথচ এই মাটিতেই একটি সময় স্বপ্ন বোনা হত, তবে ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখে এখন এমন মানুষ আর নেই বললেই চলে।

২০১৮ বিশ্বকাপে রানারাআপ ক্রোশিয়ার সঙ্গে নব্বই দশকে র‍্যাংকিং এ খুব বেশি পার্থক্য ছিল না বাংলাদেশের। অথচ তারা আজ মদ্রিচের মতো বিশ্বসেরা তারকা তৈরি করছে, বিশ্বকাপে অংশ নেয়া পানামা নব্বই দশকে বাংলাদেশের থেকে পাঁচ ধাপ পিছিয়ে ছিল! এখন তারা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করছে, আমরা সাফে ব্যর্থ হলেও নেই কোনো জবাবদিহিতা। আমরা আমাদের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রবাসী বাংলাদেশি ফুটবলারদের দলে ভিড়িয়ে মান সম্মান রক্ষার চেষ্টায় আছি! তাতে যে খুব বেশি লাভ হচ্ছে তাও না, গত কয়েক বছরে ফুটবলের ব্যর্থতাই বলে দেয় সব চিত্র। বিশ্বকাপ কিংবা এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের কথা বাদও যদি দেয়া হয়, দক্ষিণ এশিয়ার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেই কোনো সাফল্য। একের পর এক কোচ বদল করেও হয়না কোনো সমাধান। বোর্ডের কর্তারা যেনো সব জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। দেশের ফুটবল যখন ধ্বংসের দারপ্রান্তে তখন চারপাশ থেকেই যেনো আওয়াজ আসছে পরিবর্তনের। বারবার নির্বাচিত হয়েও কাজী সালাউদ্দিন প্যানেল প্রতিবার দেশের ফুটবলকে শুধু পেছনেই নিয়েছেন, সামনে আগানোর পথ যেনো রুদ্ধদ্বার! আমাদের নেই কোনো সুদূর পরিকল্পনা, শুধু অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে সব।

ফুটবল এদেশের মানুষের প্রাণ, বিশ্বকাপ আসলে যে দেশে পাগলামীর সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তা দেখেও কি বাফুফের কর্তাদের বোধদয় হয় না! নাকি তারা কাঠের চশমা পরে থাকেন! এই জনপ্রিয়তাকে কেনো আমরা কাজে লাগাতে পারলাম না! কেনো মাত্র ২০ লাখ টাকার জন্য সাফ জয়ী নারী ফুটবলাররা অলিম্পিক বাছাই খেলতে যেতে পারে না? কেনো বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ নামে টুর্নামেন্টে নিচু সারির দল এনে টুর্নামেন্ট চালানো হয়? বাফুফের কর্তাদের দুর্নীতি ফিফা খুঁজে পায় অথচ বাফুফে খুঁজে পায় না! কেনো আমাদের ফুটবলের জন্য আন্তর্জাতিক মানের একাধিক মাঠ নেই? এত কেনোর কি জবাব আছে বাফুফের কাছে? রোম যখন নাকি পুড়েছিল, নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। যেখানে আমাদের আবেগ ফুটবল দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, সেখানে বাফুফের কর্তাদের ফুটবল উন্নয়নের দিকে কোনো নজরই নেই! অথচ এরাই গত দেড় দশক ধরে বোর্ড পরিচালনা করছেন! এখন অব্দি নিজেদের ব্যর্থতার দায়টুকু নেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়নি তাদের!

এরকম ফুটবল পাগল জাতি আমরা অথচ আমাদের ফুটবল এখন আইসিউতে! বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বড় বাজার হলেও, ফুটবলের বাজার আমরাই তৈরি করতে পারিনি। পূবার্শবর্তী দেশ ভারত দু’দশক আগেও যাদের সঙ্গে আমাদের র‍্যাংকিং পার্থক্য ছিল সামান্য, অথচ সুদূর পরিকল্পনা হাতে নেয়ায় তাদের ফুটবল ;কিন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে! ভারত বর্তমানে র‍্যাংকিং এ ১০০-এর কাছাকাছি, অথচ আমাদের অবস্থান প্রায় শেষের দিকে! বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৮টি করা হচ্ছে, তাই সুযোগ তৈরি হচ্ছে ভারতের সামনে! হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ফুটবল বিশ্বকাপে অংশ নিতে দেখা যাবে সুনীল ছেত্রীর উত্তরসূরীদের। পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়নের কারণে ভারত এখন বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা দেখছে। অথচ সঠিক পরিকল্পনা করে আগাতে পারলে আমরাও হয়তো এখন সেই স্বপ্ন দেখতে পারতাম। তবে সেই স্বপ্ন এখন আমাদের জন্য শুধুই দুঃস্বপ্নের মতো। আমাদের গলাফাটাতে হয় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানী কিংবা স্পেনের জন্য! বাফুফের কর্তাদের যারা বড় বড় পদে আসীন তাদের অনেকেই সাবেক ফুটবলার এবং একসময়ের দেশ সেরা ফুটবলার এরা। বিশেষ করে বোর্ড সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে নাকি দক্ষিন এশিয়ার ম্যারাডোনা বলা হত! অথচ এদের হাতে ফুটবল লজ্জিত হয়েছে বারবার। বাফুফের সাধারণ সম্পাদককে দুর্নীতির দায়ে ২ বছর নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। এরপর থেকে আলোচনায় আসতেছে বাফুফের দুর্নীতির বিভিন্ন চিত্র। ফুটবলের এমন অবনমনের পরও বাফুফে আজ পর্যন্ত এর কোনো দায় নেয়নি। বরং ফুটবলার আর কোচদের ওপর দায় চাপিয়ে চলছে বাফুফে কর্তারা।

দেশের টানে জামাল ভূইয়া কিংবা তারেক কাজীরা ইউরোপের জীবনযাত্রা ত্যাগ করে বাংলাদেশে এসেছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ঘুরে দাঁড়িয়েছিল একটা প্রজন্মের হাত ধরে। মাশরাফি, তামীম, সাকিব, মুশফিক কিংবা রিয়াদদের হাত ধরে ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। একটা প্রজন্মের হাত ধরে ২০১৮ ফুটবল বিশ্বকাপে রানারাআপ হয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। আর একটা প্রজন্মের হাত ধরে ৩৬ বছর পর শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা! আমাদের ফুটবলে একটা প্রজন্ম দরকার, যারা আমাদের স্বপ্ন দেখাবে, যারা সাফ চ্যাম্পিয়ন হবে যারা এশিয়া কাপে অংশ নেবে! রাতারাতি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নপূরণ হবে না, তবে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে এক সময় হয়তো সেটা সম্ভব! তবে সেই প্রজন্মটা আমাদের কবে তৈরি হবে? আর প্রজন্মকে এগিয়ে নেয়ার মতো পথ প্রদর্শকই বা কারা হবে? কবে এসব অজানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে? কবে?

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত