ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব

ইমরান খানের ভবিষ্যৎ

ড. মাহবুব মোমতাজ, কবি, কলামিস্ট, [email protected]
ইমরান খানের ভবিষ্যৎ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র নামে বাঙালির ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। রাজনৈতিক সমাধান না করে সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরতা পাকিস্তানের ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক নির্মম ধারা আজও চলছে। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার সে পথে না হেঁটে বন্দুক, বোমা আর বেয়েনেটের ভাষায় সমাধানের পথে গিয়েছিল। কারণ পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাস সামরিকতন্ত্রের ইতিহাস। অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনায় সেনাবাহিনী প্রধান টিক্কা খানকে বলা হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নয় মাটি চাই।’ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজেও একসময় সেনাপ্রধান ছিলেন। ফলে রাজনীতির ভাষা তিনি বুঝতে চাননি। সেনাবাহিনীকে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছিলেন বলে তার পরিণতি ভালো হয়নি। লেখার শেষের দিকে আমরা তা দেখতে পাব।

১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা পেলেও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে তারা চলেছে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। ৯ বছর লেগেছে সংবিধান তৈরি করতে। অন্যদিকে ভারত ১৯৫০ সালেই নিজেদের সংবিধান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা করেছে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্রিটিশ নীতি অনুসরণ করে স্বাধীনতার পর নিজে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালে তার মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দিন হয়েছিলেন গভর্নর জেনারেল। সংবিধান প্রণয়ন ও কোনো নির্বাচনের পথে না হেঁটে গভর্নরের শাসন বলবৎ রেখেছিলেন ইস্কান্দার মির্জা পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে সামরিক শাসন শুরু হয় ইস্কান্দার মির্জার হাতে। ইস্কান্দার মির্জা নিজেও ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে আসা ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রথম প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন। হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং একসময় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় গভর্নর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মদকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিজে গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গড়ে তোলেছিলেন রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টি। ১৯৫৭ সালে ইস্কান্দার মির্জা রাজনীতির বাইরের অনভিজ্ঞ একজন তরুণ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তার সরকারের প্রবেশ করান।

১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে বুঝিয়ে তিনজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে সুপারসিড করে আইয়ুব খানকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিতে ইস্কান্দার মির্জা সুপারিশ করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খানকে সামারিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়ার মাত্র ২২ দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেশ ছাড়া করেন। মির্জার প্রিয়ভাজন জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আইয়ুব খান প্রথমে বাণিজ্য পরে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। আইয়ুব খানের শাসনামলের পুরো সময় সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন ভুট্টো। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধে তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ সমাপ্তির প্রতিবাদে জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুব খানকে ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি (পিপিপি) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।

১৯৫৮ সাল থেকে আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। সংবিধান স্থগিত করে ১৯৬২ সালে নিজের মতো করে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে টিকে থাকতে ১৯৬২ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন চেয়ে ৬ দফা পেশ করে জনগণের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তার বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে আইয়ুব খান প্রহসনের বিচার শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন এবং সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করেন। পাকিস্তানে দ্বিতীয় দফা সামরিক শাসন শুরু হয়। আবার ক্ষমতা পায় সেনাবাহিনী প্রধান। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী যেন এক অনিবার্য বিষয়।

সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খান পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে ঘোষণা করেন ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। সত্তুরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে পরামর্শ করে বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি শুরু করে। ৭ মার্চ প্রায় ১০ লাখ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন। ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেন।

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করেন। এই ইয়াহিয়া খান একসময় ছিলেন ভুট্টোর খুব কাছের মানুষ। ১৯৭১ সালে ভুট্টোকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে বাঙালিকে নিধনযজ্ঞে নেমেছিলেন। ইতিহাসের নির্মমতা হচ্ছে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়ে ইয়াহিয়াকে গৃহবন্দি করেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল গুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান রহিম খানসহ একাধিক সেনা কর্মকর্তাকে ভুট্টো চাকুরিচ্যুত করেন। নতুন সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে বেছে নেন টিক্কা খানকে।

টিক্কা খান ১৯৭৬ সালে ভুট্টোর কাছে নতুন সেনাপ্রধান করার সুপারিশ করেছিলেন জেনারেল আকবর আলী খানকে।

ভুট্টো সে সুপারিশ না শুনে ৬ জন সেনা অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল জিয়াউল হককে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান করেন। ১ বছরের মাথায় ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে তৃতীয়বারের মতো সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল জিয়াউল হক। ১৯৭৯ সালে ৫ বছর আগের পুরোনো এক হত্যা মামলায় ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু কার্যকর করেন। আর সেনাপ্রধান জিয়াউল হক ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থেকে ১৯৮৮ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় জিয়া মৃত্যুবরণ করেন।

পাকিস্তানের গত ৭৮ বছরের ইতিহাসে ৩০ বছরের অধিক সময় সামরিক শাসনে কেটেছে। সেনাবাহিনী আর আমলাদের কাছে রাজনীতি থেকেছে বন্দি। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব মাত্রাতিরিক্ত।

২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে সমালোচনা ছিল, সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ২০২১ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রধানের পদ নিয়ে।

ইমরান খান জেনারেল আসীম মুনির যিনি এ পদে আসীন ২০১৯ সালে তার মেয়াদ কমিয়ে জেনারেল ফয়েজ হামিদকে গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানের পদে বসান। এটি ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ। ২০২২ সালে নাটকীয়ভাবে সেই অসীম মুনির সেনাবাহিনী প্রধান হন। ফলে ইমরানের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। আবার শুরু হয় সেনাবাহিনীর প্রভাব। পাঞ্জাবে এক জনসভায় ইমরানকে গুলি করা হয়েছিল হত্যার উদ্দেশে। ইমরান সন্দেহ করছেন তাকে হত্যা করা হতে পারে। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খান সরকারের দূরত্ব বাড়তে থাকলে শেষ পর্যন্ত ইমরান খানকে ২০২২ সালে পদত্যাগ করতে হয়। গত ৯ মে আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হলে পাকিস্তানে ভয়াবহ বিক্ষোভ অগ্নিসংযোগ দাঙা শুরু হয়। পিটিআই কর্মীরা ক্যান্টনম্যান্ট আক্রমণ করে। সেনা আবাস ভাঙচুর করেছে। এ লেখা যখন লিখছি ১১ মে ইমরান খানকে পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট দুই সপ্তাহের জামিন দিয়েছে। জামিনের মেয়াদ কতদূর বাড়বে, আর পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খান কতটা শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারবে তা এখন দেখার বিষয়। কারণ পাকিস্তানের অতীত ইতিহাস সেনাবাহিনী আর রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্ব সুখকর নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত