ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

আর কে চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ
আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

আর্সেনিকের বিষক্রিয়া বা আর্সেনিকোসিস রোগটি বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ২০১২ সালে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার ৯১০ জন। এর পর বড় ধরনের কোনো জরিপ পরিচালিত হয়নি। তাই বর্তমানে দেশে আর্সেনিকোসিস রোগীর সংখ্যা কত তা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে প্রায় ৮ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ এই রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের রক্ষায় এখনই ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

১৯৯০-এর দশক থেকেই দেশে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া পরিলক্ষিত হতে থাকে। এই বিষক্রিয়ার মূল উৎস নিরুপিত হয় নলকূপের পানি। ২০০৩ সালে দেশব্যাপী নলকূপের পানি পরীক্ষা করে দেখা যায়, পরীক্ষাকৃত নলকূপের ২৯ শতাংশের পানিতেই মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) সাম্প্রতিক সময়ের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে দেশে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। ডিপিএইচই ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৪ জেলার মোট ৭২ লাখ নলকূপে আর্সেনিক পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ১৩.৯১ শতাংশ নলকূপে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এর একটি বড় কারণ আর্সেনিক সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে এবং গভীর নলকূপ বসানোর হার অনেক বেড়েছে। সাধারণত অগভীর নলকূপে আর্সেনিক দূষণ অনেক বেশি হয়। তবে দেশের কিছু এলাকায় এই হার মারাত্মকভাবে বেশি রকমের। যেমন- গোপালগঞ্জ জেলায় এ হার ৫২.৫৭ শতাংশ, চাঁদপুর জেলায় ৫২.৩৫ শতাংশ. কুমিল্লায় ৪৪.৯১ শতাংশ, সাতক্ষীরায় ৪০.৮৫ শতাংশ।

আর্সেনিক দীর্ঘদিন ধরে শরীরে প্রবেশ করতে থাকলে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে বমি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদি। ক্রমে তা নানা ধরনের রোগের প্রকাশ ঘটাতে থাকে। চর্মরোগ, হাত-পা কিংবা শরীরের অন্যান্য স্থানের ত্বকে ঘায়ের সৃষ্টি হয়। অত্যধিক মাত্রায় আর্সেনিক গ্রহণের কারণে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মেটাবোলিক সিনড্রোম, বুদ্ধিবৈকল্য, অ্যাজমা, এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগও দেখা দিতে পারে। তাই আর্সেনিকোসিস এবং পরবর্তী সময়ে জটিলতায় মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি হয়।

আর্সেনিকোসিসে আক্রান্তদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাদের পক্ষে সঠিক চিকিৎসা করানোও সম্ভব হয় না। কোনো কোনো পরিবারে দেখা যায়, সবাই এ রোগে আক্রান্ত। তাই আর্সেনিকোসিস মোকাবিলায় গ্রামাঞ্চলে নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি আর্সেনিকোসিসে আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করতে হবে।

আর্সেনিক একটি নীরব ঘাতক, তবে এটি কোনো ছোঁয়াচে বা বংশগত রোগ নয়। পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি থাকলে পানকারীর শরীরের নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে। এটি দেশের বেশ পুরোনো একটি সমস্যা এবং এখনও অনেক অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতেই আর্সেনিকের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। দুঃখজনক হলো, বিষয়টি নিয়ে আগের মতো আলোচনা নেই। আর্সেনিক পরিস্থিতি, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং তাদের চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ডিপিএইচই-এর কার্যক্রমে বড় ঘাটতি রয়েছে। সরকার বিশেষ নজর না দিলে দেশে আর্সেনিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

দেশে যেসব অঞ্চলের মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে আছেন, সেসব অঞ্চল অতি দ্রুত চিহ্নিত করতে হবে। ওই অঞ্চলের পানিকে কি করে আর্সেনিকের দূষণমুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। আর্সেনিক দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টিউবওয়েল বসানোর আগে অবশ্যই মাটির নিচের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পুরোনো নলকূপের পানিতে আর্সেনিক মাত্রা এবং আশেপাশের টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাও পরীক্ষা করাতে হবে; টিউবওয়েল বসানো শেষ হলে গোড়া বাঁধানোর আগে আবার আর্সেনিক পরীক্ষা করাতে হবে; টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া গেলে টিউবওয়েলের মুখ লাল রং করতে হবে, আর স্বাভাবিকের চেয়ে কম পাওয়া গেলে সবুজ রং করতে হবে; লাল রং করা টিউবওয়েলের পানি পান করা বা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না; আর্সেনিক যুক্ত পানি ফুটিয়ে খাওয়া যাবে না। কারণ ফুটালে আর্সেনিক দূর তো হয়ই না বরং পানি শুকিয়ে তাতে আর্সেনিকের ঘনত্ব আরও বেড়ে যাবে; আর্সেনিক মুক্ত টিউবওয়েলের পানি প্রতি ৬ মাস পরপর পরীক্ষা করে দেখতে হবে পানি আর্সেনিক দূষণমুক্ত আছে কি না; কুয়ার পানিতে আর্সেনিক আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে; বৃষ্টির পানি সংগ্রহের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আর্সেনিকমুক্ত ও নিরাপদ পানি পাওয়া যায়। তাই বৃষ্টি পানি সংগ্রহ করে খাওয়া ও রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হবে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বলা হয়েছিল যে, ২০১১ সালের মধ্যে আর্সেনিকের সমস্যা সমাধান করে সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। এটা সত্য যে গত দুই দশকে আর্সেনিক দূষণের পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। দেশে অগভীর নলকূপের সংখ্যা কমেছে। এতে আর্সেনিক দূষণের শঙ্কা কমেছে। জনসাধারণ এ বিষয়ে সচেতন হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি আরও ভালো হতে পারত। যে গতিতে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপের কাজ এগোচ্ছে, তাতে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে একযুগেরও বেশি সময় লাগতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তবে শুধু পানির জোগান নিশ্চিত করলেই চলে না, পানিকে অবশ্যই নিরাপদ হতে হবে। কেননা, খাবার পানি যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে মানুষের সামগ্রিক জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার আরও জোরদার প্রচেষ্টা চালাবে- সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত