বেশ কিছুদিন ধরেই প্রকৃতিতে অনুভব করছি প্রচণ্ড গরম। দুঃসহ এ গরম থেকে বাঁচতে মানুষের জীবন কাহিল হয়ে পড়েছে। এ গরম কমার যেন কোনো লক্ষণই নেই। বরং সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। বিশ্বের অধিকাংশ সমুদ্রসীমায় আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে চলতে শুরু করেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী বর্তমান জলবায়ু সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আজ প্রকৃতির এমন কঠিন রূপ আমাদের দেখতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আজ খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বন্যা এসব প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রভাবে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে তাপমাত্রা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং উষ্ণতাপ্রবণ এলাকা বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা বারবার বলেছেন, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস বা বন্ধ না করা হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বাড়বে এবং এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বেড়ে যাবে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে এমন দিনের সংখ্যা আশির দশকের তুলনায় বর্তমানে দ্বিগুণ বাড়ছে। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৪ দিন তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। আর ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল বছরে ২৬ দিন। একদিকে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের আভাস, অন্যদিকে দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ। এর মধ্যে বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ এলাকার মানুষ জীবন অতিষ্ঠ করা গরমে কষ্ট পাচ্ছে। তাপমাত্রা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি (৮ মে ২০২৩) ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গত ৩৪ বছরের মে মাসের রেকর্ড ছুঁয়ে গেছে। আর সারা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও ৯ বছরের রেকর্ড ছুঁয়ে গেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস এপ্রিলের পর মে মাসে সারা দেশের তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়। এবার এপ্রিল মাস অন্য বছরগুলোর তুলনায় বেশি উষ্ণ থাকার পর মাসের শেষের দিকে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। কিন্তু মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবারও তপ্ত দিন শুরু হয়ে যায়। গত ৮ মে ঢাকার তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৮৯ সালের ৮ মে’র পর মে মাসের কোনো দিনে এটাই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। শুধু ঢাকাতেই নয়, একই দিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ মে যশোরে একই তাপমাত্রা উঠেছিল। ১৯৯৫ সালের ২৮ মে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল যশোরে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশের ওপর দিয়ে যে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী কয়েক দিন তাপমাত্রা বেড়ে দেশের উষ্ণতা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
প্রচণ্ড এ তাপপ্রবাহ চলছে পুরো এশিয়াজুড়ে। এর মধ্যে ভিয়েতনাম ও লাওসে তাপমাত্রার সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে গেছে। ভিয়েতনামে তাপমাত্রার রেকর্ড ৪৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। ভিয়েতনামের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার রেকর্ড। একই দিনে লাওসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে। দেশটির লুয়াং প্রাবাংয়ে তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে পৌঁছায়। থাইল্যান্ডে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ওঠার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর এশিয়ার দেশগুলোয় নতুন করে তাপমাত্রা রেকর্ড স্পর্শ করতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ফিলিপাইনের তাপমাত্রাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৩ সাল বিশ্বের উষ্ণতম বছর হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভিয়েতনামে তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। আগামী দিনগুলোয় দেশটিতে আরও গরম পড়তে পারে। দেশটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রার এই রেকর্ড হয়েছে গত ৬ মে ২০২৩, ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে থান হোয়া প্রদেশে। এ তাপপ্রবাহের কারণে স্থানীয় প্রশাসন মানুষকে দিনের উষ্ণতম সময়ে বাড়ির বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এর আগে ভিয়েতনামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। চার বছর আগে দেশটির মধ্যাঞ্চলের হা থিন প্রদেশে এ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। শুধু ভিয়েতনাম নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোও প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হয়েছে। থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলের মাক প্রদেশে তাপমাত্রা রেকর্ড ৪৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছে। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ নুগুয়েন নাগোক হুই বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভিয়েতনামে গরম ক্রমেই বাড়ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার নতুন রেকর্ড সত্যি উদ্বেগের। আমি মনে করি, ভবিষ্যতে তাপমাত্রা এবারের এই রেকর্ডও ছাড়িয়ে যেতে পারে।’
তাপমাত্রা বৃদ্ধির এমন ঘটনায় আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন। প্রশ্ন জাগছে, আধুনিকায়নের ফলে আমরা কেন এ সুন্দর পৃথিবীটাকে সহজেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আজ আমরা পরিবেশ এবং প্রকৃতির যে ভয়াবহ রূপ পর্যবেক্ষণ করছি, যেভাবে দিন দিন অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা- তাতে গভীর এক শঙ্কা সহজেই নাড়া দিচ্ছে বারবার। জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমাদের কি কোনো ভূমিকাই নেই? এ প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ রোধে আমরা সবাই মিলে কি সচেতন হতে পারি না?