বজ্রপাত বলতে আকাশের আলোর ঝলকানিকে বোঝায়। এ সময় এলাকার বাতাসের প্রসারণ এবং সংকোচনের ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে। বজ্রপাতে ডিসি কারেন্ট তৈরি হয়। বজ্রপাতে যেহেতু প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ ভূগর্ভে চলে যায়, সেহেতু এর প্রভাব ভূগর্ভে অনেক মূল্যবান পদার্থের খনি বা আকর হওয়ার সম্ভবনাকে নস্যাৎ করে। বজ্রপাতের ফলে বিশাল পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। মেঘ থেকে ভূমিতে হওয়া একটি সাধারণ বজ্রপাতে প্রায় ১ বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন হয়।
বায়ুমণ্ডলের ওপরের অংশে নিচের তুলনায় তাপমাত্রা কম থাকে। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায় যে, নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে মেঘের প্রবাহ হয়। এ ধরনের মেঘকে থান্ডার ক্লাউড বলে। অন্যান্য মেঘের মতো, এ মেঘেও ছোট ছোট জলের কণা থাকে। আর উপরে উঠতে উঠতে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে জলের পরিমাণ যখন ৫ মি.মি.-এর বেশি হয়, তখন জলের অণুগুলো আর পারস্পরিক বন্ধন ধরে রাখতে পারে না। তখন এরা আলাদা হয়ে যায়। ফলে সেখানে বৈদ্যুতিক আধানের সৃষ্টি হয়। আর এ আধানের মান নিচের অংশের চেয়ে বেশি হয়। এরকম বিভব পার্থক্যের কারণেই ওপর থেকে নিচের দিকে বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন হয়। এ সময় আমরা আলোর ঝলকানি বা বজ্রপাত দেখতে পাই।
বজ্রপাতের সময় আগে আলো দেখা যায় এবং পরে শব্দ শোনা যায়। এর মূল কারণ আলো এবং শব্দের বেগের পার্থক্য। আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার। অন্যদিকে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াাস তাপমাত্রায় শব্দের গতি প্রতি সেকেন্ডে ৩৩২ মিটার। গতির এ পার্থক্যের কারণে বজ্রপাতের শব্দ বিদ্যুৎ চমকানোর একটু পরে শোনা যায়। প্রতি বছর আমাদের দেশে বজ্রপাতের কারণে অনেক লোক মারা যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-২০১৯ সালে ১০ বছরে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৮১। তবে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে। সে বছর বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৫৯ জন।
অতএব, বজ্রপাতকে মোটেও হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সতর্কতাগুলো বিশেষভাবে অনুকরণীয়-
১। বজ্রপাতের সময় সবচেয়ে নিরাপদ হলো- কোনো দালান বা পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নেয়া। ঘন ঘন বজ্রপাতের সময় কোনোভাবেই ঘর থেকে বাইরে যাওয়া উচিত নয়।
২। বজ্রপাতের সময় কখনোই বাইরে বা খোলা জায়গায় থাকা উচিত নয়। খোলা ও উঁচু জায়গায় বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই এমন অবস্থা দেখা দিলে খোলা বা উঁচু স্থান থেকে সরে আসতে হবে এবং নিরাপদ কোনো স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
৩। বজ্রপাতের সময় আমরা অনেকেই গাছের নিচে আশ্রয়কে বেশি নিরাপদ ভেবে থাকি এবং এ পরিস্থিতিকে নিরাপদ ভেবে থাকি, যা কি-না মোটেও সঠিক নয়। নিরাপদ থাকতে হলে সবসময় বিদ্যুৎ লাইন ও উঁচু গাছপালা থেকে দূরে থাকা উচিত। এসব জায়গায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশেষ করে বড় কোনো খোলা জায়গায় গাছ থাকলে সেখানে বজ্রপাতের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেয়া একদমই উচিত নয়।
৪। গাড়ির ভেতরে থাকা অবস্থায় বজ্রঝড় শুরু হলে বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। কারণ গাড়ির চাকায় ব্যবহৃত টায়ার বিদ্যুৎ অপরিবাহী অর্থাৎ বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। এটি গাড়িকে ভূমি থেকে আলাদা করে রাখে। এতে করে বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্য দিয়ে ভূমিতে আধান প্রবাহের কোনো পথ তৈরি হয় না। তবে নিকটে যদি কোনো কংক্রিটের ছাউনি থাকে, তাহলে গাড়িতে না থেকে সেখানে আশ্রয় নেয়াই ভালো। ঘনঘন বজ্রপাতের সময় গাড়িতে না থাকাই ভালো। তবে মোটেও টিন বা লোহার কোনো ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া উচিত নয়। যদি গাড়িতেই থাকতে হয়, তাহলে বেশ কিছু সতর্কতা মেনে চলা উচিত।
পায়ের জুতা খুলে রাখলে দ্রুত জুতা পরে নিতে হবে। বেশি ভালো হয় পা সিটের ওপর তুলে বসলে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনোভাবেই যেন শরীর গাড়ির বডি বা ধাতব কোনো কিছু স্পর্শ না করে থাকে। মনের ভুলেও গাড়ির কাচে হাত দেয়া যাবে না।
৫। ঘরে থাকলে কখনোই জানালার কাছে থাকা যাবে না। ভালো করে জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং জানালা থেকে যথেষ্ট দূরে থাকতে হবে।
৬। বজ্রপাতের সময় ঘরে থাকলে আরও কিছু জরুরি বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কোথাও কোনো ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় সিঁড়ির রেলিং, বাড়ির ধাতব কল, ধাতব পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। টিভি কেবল, ল্যান্ড লাইন, টেলিফোন ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় এগুলো স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন, আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৭। বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি সম্পর্কে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। এসব যন্ত্রপাতিকে বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন করে রাখাই ভালো। ঝড় ও বজ্রপাতের শঙ্কা দেখা দিলে এসব যন্ত্রপাতির প্লাগ খুলে দিতে হবে। ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়া অবস্থায় থাকলে বজ্রপাতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে এবং এ থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বন্ধ করা থাকলেও হাত দিয়ে ধরা যাবে না।
৮। বজ্রপাতের সময় অনেকেই ভয় পেয়ে কানে আঙুল দিয়ে চেপে ধরে। এটি বেশ ভালো একটি অভ্যাস। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ শ্রবণ শক্তি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। কাজেই ব্যাপারটি অনেকের কাছে উদ্ভট ঠেকলেও আপনাকে সুরক্ষা দেবে।
৯। বজ্রপাতের সময় পানি থেকে সর্বদা দূরে থাকতে হবে। পানি খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী হওয়ায় বজ্রপাতের সময় পানিতে থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বজ্রপাতের সময় ছোট কোনো পুকুরে সাঁতার কাটলে বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকলে সেখান থেকে উঠে আসতে হবে।
১০। নিজের চেয়ে উঁচু কোনো স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়া যাবে না। বজ্রপাতের সময় কোনো খোলা জায়গা যেমন- ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। বাড়িতে কোনো উঁচু স্থান যেমন বাড়ির ছাদে থাকলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে যেতে হবে।
১১। যদি নিরুপায় হয়ে কোনো খোলা জায়গায় থাকতে হয়, তাহলে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। তবে মনের ভুলেও শুয়ে পড়া যাবে না। কয়েকজন থাকলে পরস্পর থেকে দূরে থাকতে হবে এবং প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যেতে হবে। কখনোই সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়ে থাকা যাবে না।
১২। অনেক সময় বজ্রপাতের আগে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। বিদ্যুতের প্রভাবে চুল খাড়া হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও ত্বক শিরশির করা বা বিদ্যুৎ অনুভূত করার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অনেক সময় আশপাশে থাকা কোনো ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে। এমন পরিস্থিতি বা কোনো ধরনের লক্ষণ পেলে সাবধান হয়ে যেতে হবে। এমন লক্ষণ প্রকাশ পেলে বুঝে নিতে হবে সন্নিকটেই বজ্রপাত হবে। দ্রুত সতর্ক হতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদ স্থানে চলে যেতে হবে।
১৩। গ্রামে অনেকেরই কাঁচাঘর থাকে। এরকম ঘরে থাকার সময় সরাসরি মাটির ওপর না থেকে বিছানার ওপর উঠে বসে থাকতে হবে। কোনো কারণে যদি মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাহলে রাবারের জুতা পড়তে হবে। চামড়ার জুতা পরে বা খালি পায়ে থাকলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ।
১৪। বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাড়ি সুরক্ষিত করতে হবে। এজন্য বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার সময় আর্থিং সংযুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিয়ে সঠিকভাবে আর্থিং সংযোগ দিতে হবে। ভুলপদ্ধতি অবলম্বন বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
১৫। বজ্রপাতে আক্রান্ত ব্যক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারা যান। তবে কেউ কেউ আহত হয়েও থাকেন। কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় দ্রুত চিকিৎসক ডেকে চিকিৎসা করালে। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বজ্রাহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন আছে কি না তৎক্ষণাৎ পরীক্ষা করতে হবে এবং না থাকলে আনার জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।