ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আপনাদের ভাবনা

বৃক্ষবলয় কমায় ক্ষতি

জিহাদ হোসেন রাহাত
বৃক্ষবলয় কমায় ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলা কিংবা অতীতের প্রলয়ঙ্করী সিডর, আইলা থেকে দেশের মানুষের জানমাল কিছুটা হলেও রক্ষায় জোরালো ভূমিকা রেখেছে এদেশের গাছগাছালি-বৃক্ষরাজি। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর অক্সিজেনের জোগানদান কিংবা প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বৃক্ষই আমাদের পরম বন্ধু- সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’- এই স্লোগানটি ছোট-বড় ভবনের দেয়ালে, জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে, বাস, রেল, লঞ্চঘাটে এবং ছোট-বড় যানবাহনের পেছনে থাকে সাঁটানো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বৃক্ষপ্রেম নেই আমাদের হৃদয়ে আঁটানো। বই, পুস্তক আর বিজ্ঞাপনে আমাদের মধ্যে বৃক্ষপ্রেম লক্ষ্য করা গেলেও বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও মেলে না। দেশের অভ্যন্তরে বৃক্ষ নিধনের মাত্রা কতটুকু বেড়েছে, সেটি দেশের সার্বিক তাপমাত্রা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বড় বড় সমস্যাগুলো বিবেচনায় এনে আর পরিমাপ করার প্রয়োজন পড়ে না বললেই চলে।

সাম্প্রতিক সময়ে তাপমাত্রার বিধ্বংসী আচরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, আমরা আমাদের পরিবেশের কতটুকু ক্ষতি সাধন করেছি। কী পরিমাণে অত্যাচার চালিয়েছি তথা চালাচ্ছি প্রকৃতির ওপর। স্মরণকাল থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দেশে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গাছ কাটার এমন মহোৎসবের পেছনে অবশ্য কিছু দৃশ্যমান কারণও রয়েছে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়, সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের কথা, দেশে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সড়ক প্রশস্তকরণসহ আরও অনেক কাজে কাটা হচ্ছে গাছ। আবার বড় বড় শিল্পকারখানা তৈরি, হাউজিং ব্যবসায় এবং বাসস্থান তৈরিতেও নিধন হচ্ছে বৃক্ষ। তবে বর্তমান চাহিদার তুলনায় এসব জিনিসের প্রয়োজন থাকলেও এই প্রয়োজন পূরণে করা হয় না পরিকল্পিত উপায় অবলম্বন। ফলে হাজার হাজার একর বনভূমি উজাড় হলেও থাকছে না কিছুই করার। বনভূমি উজাড় হওয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলে বাড়ছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রাও। তাপমাত্রা বাড়ার পেছনে যে বৃক্ষনিধন বিষয়টি অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে- সেটি হয়তো বুঝতে পারছি না আমরা। কবে নাগাদ ফিরবে আমাদের বোধশক্তি তাও এক ধরনের অনিশ্চিত।

এ যে ঘূর্ণিঝড় মোখা এলো। বাংলাদেশে আঘাত হানার আগ মুহূর্তে কিন্তু সেটির গতিপথ পরিবর্তন হয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে আঘাত হানে। সেখানে আঘাত হানার আগে আমাদের দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ। মিয়ানমারে আঘাত হানার পরপরই স্থানীয় একটি বিমানবন্দরে ভবন ধসের ঘটনা ঘটে এবং তিনজন নাগরিক নিহত হয়। আজ যদি টেকনাফ ও কক্সবাজার উপকূলে বৃক্ষ বলয় থাকত, তাহলে হয়তো এ প্রাণগুলো অকালে ঝরে যেত না। রক্ষা পেত অনেক ঘরবাড়ি, রক্ষা পেত মানুষের জানমাল। এখন প্রশ্ন হলো, কবে নাগাদ সচেতন হবো আমরা? কবে বন্ধ হবে আমাদের বৃক্ষ নিধন মহোৎসব? আদৌও কি সম্ভব হবে বৃক্ষনিধন মহোৎসব রোধ করা? মনে জমা এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাব কি-না, সেটিও এখন ভাবনার বিষয়।

উল্লেখ্য, একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে দেশের মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা আবশ্যক। অথচ সেখানে, বাংলাদেশের বনভূমি আছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশের মতো। একটু লক্ষ্য করলে দৃশ্যমান যে, দেশের প্রয়োজনীয় বনভূমির তুলনায় বনভূমি রয়েছে শতকরা ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মোট ঘাটতি রয়েছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অবশ্য এই ঘাটতি অংশের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের জলবায়ুর ওপর। এতে করে প্রতি বছর ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্তত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পেছনে বড় কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশে গত ৬০ বছরে ছোট-বড় অন্তত ৩৩টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। গত ১৫ বছরে দেশে আঘাত হেনেছে প্রায় ৯টির মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বছরে গড়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই। গত বছরের (২০২২) মার্চ মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপ বলছে, গত ৬ বছরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। জরিপের তথ্য মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষি খাতে ৫৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শস্য খাতে ২৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।

মোখার মতো আর কত ঘূর্ণিঝড় আসলে ঘুম ভাঙবে আমাদের- সেটির পরিমাপ নাইবা করি। অন্তত দেশের প্রান্তিক মানুষগুলোর জানমালের কথা বিবেচনায় নিয়ে হলেও আমাদের নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন মহোৎসব বন্ধ করতে হবে। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়ার পাশাপাশি মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।

তরুণ কলামিস্ট

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত