পর্যালোচনা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি এবং বাংলাদেশে তার প্রভাব

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১৩ মাস অতিক্রান্ত হয়ে ১৪তম মাস চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ যুদ্ধ আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। গত ১৭-১৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত সিকিউরিটি কনফারেন্সে যোগ দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ন্যাটোর মাধ্যমে ইউক্রেনে আরও অধিক সামরিক সহায়তা অর্থাৎ অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়াকে ‘পর্যুদস্ত’ করার জন্য জোটবদ্ধ হয়েছে। কেউ সমঝোতা বা আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের কথা বললে ন্যাটোভুক্ত জোট তা আমলে নিচ্ছে না। তাদের কথা হলো আগ্রাসী দেশ রাশিয়াকে ‘শায়েস্তা’ করতে হবে। এদিকে এ যুদ্ধের বর্ষপূর্তির কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনে উপস্থিতির মাধ্যমে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার বিষয় জানান দিয়েছেন। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দূরপাল্লার হিমারস রকেট আর্টিলারি ক্ষেপণাস্ত্র, পোল্যান্ড ও ব্রিটেন যুদ্ধবিমান এবং জার্মানি অত্যাধুনিক ল্যাপার্ড ট্যাংক সরবরাহ করে ইউক্রেন বাহিনীকে শক্তিশালী করেছে। শোনা যাচ্ছে চীন এ যুদ্ধে রাশিয়াকে সহায়তা করবে। ন্যাটো বাহিনী যদি সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করছে নিরাপত্তা ও সমরবিশারদরা। রাশিয়া এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব ও ন্যাটো ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিলেও রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করে যুদ্ধ শেষ করতে পারবে মনে করলে ভুল করা হবে, বরং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনকে যুদ্ধে মদদ দিলেও সে দেশের জনগণ সরকারের এ পদক্ষেপ পছন্দ করছে না। হাজার হাজার মানুষ ওয়াশিংটন ডিসিতে মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। তারা ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় করার বিরুদ্ধে, বরং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট কমানো এবং ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়ার পক্ষপাতী। একইভাবে ফ্রান্স ও জার্মানিতে জনগণ ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তার বিপক্ষে বিক্ষোভ করেছে। তাদের ভাষায়, ‘এ যুদ্ধ আমাদের নয়। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে ইউরোপের দেশগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হচ্ছে। ইউরোপজুড়ে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। ব্রিটেনের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা নির্দিষ্ট আয়ে সংসার চালাতে পারছে না। পরিবহন ও রেল শ্রমিক, ডাক বিভাগের কর্মচারী, হাসপাতালের নার্স, স্কুলশিক্ষক যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন সময় ধর্মঘট করছে। সুপার মার্কেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য রেশনিং করে বিক্রি করতে হচ্ছে। করোনা মহামারির পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাজ্য ব্যাপক চাপ ও সংকটের মধ্যে পড়েছে। জার্মানিতে মূল্যস্ফীতি কাগজে-কলমে ৯-১০ শতাংশ হলেও চাল, আটা, ভোজ্যতেল, ডিম, দুধ, সবজি প্রভৃতি ভোগ্যপণ্যের মূল্য ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে। বাস, ট্রেন, বিমানবন্দর, হাসপাতাল, কিন্ডারগার্টেন প্রভৃতি স্থানে কর্মরত শ্রমিকরা বিভিন্ন সময় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করছে। কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে, নিম্ন আয়ভুক্ত যেসব পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্মরত নেই, অর্থাৎ একজন উপার্জন করে, সেসব পরিবারের অনেকেই দিনে তিনবেলা আহার জোগাড় করতে পারছে না। ফ্রান্সে গত কয়েক মাসে বড় আকারের বেশ ক’টি বিক্ষোভ ও ধর্মঘট হয়েছে। মূল্যস্ফীতি অসহনীয় হওয়ার কারণেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারের জনপ্রিয়তা নিম্নগামী হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের জরিপে ২০২৩ সালে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোয় ভয়াবহ মন্দার পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি আঞ্চলিক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। একটি সুইস ব্যাংকও পুঁজি সংকটে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।মন্দার প্রভাবে শিল্পোৎপাদনসহ অর্থনৈতিক সংকোচনের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, ভোজ্যতেল, সারসহ শিল্পদ্রব্যের মূল্য ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে এর মধ্যে জড়িয়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রাশিয়ার আগ্রাসী যুদ্ধের অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রাশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি বিনাশ করতে চেয়েছে। কিন্তু মাত্র দেড় ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির দেশ রাশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার লক্ষ্যে আংশিক সফল হলেও নিজেও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সমরবিশারদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সামনে ঘোর বিপদের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন। ন্যাটো ও পশ্চিমাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিপরীতে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় না এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যদি রাশিয়াকে গুটির শেষ চাল দিতে বাধ্য করে, তবে তা হবে ইউরোপ ও রাশিয়া উভয়ের জন্য ঘোর বিপদ। এ সহজ কথাটি বুঝতে বিলম্ব করে যদি উভয়পক্ষ চলমান ‘বিচারবুদ্ধিশূন্য’ যুদ্ধে মেতে থাকে তবে সারা বিশ্বকে এর মূল্য দিতে হবে। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে উন্নয়নশীল বিশ্ব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনা মহামারির ধকল সামলিয়ে যখন বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পথে এগোচ্ছে তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ (যা প্রকারান্তরে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধে পর্যবসিত হয়েছে) বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে গভীর সংকট ও চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই এ যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য উন্নত দেশগুলো ও বিশ্ব সংস্থার নেতাদের প্রতি অনুরোধ ও আহ্বান জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতির জন্য যুদ্ধসৃষ্ট সংকটময় অবস্থা এক বিরাট আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে, যদিও প্রধানমন্ত্রী বহু আগে থেকে এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সতর্ক করে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় সহনশীল। ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময় বাংলাদেশে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি। দেশে উৎপাদন, ভোগ চাহিদা, সরকারি ব্যয়, নতুন বিনিয়োগ প্রবৃত্তি সচল ছিল। গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। অনুরূপভাবে করোনা মহামারির সময় দেশে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন ও সরবরাহ এবং বৃহত্তর জনগণের ভোগ চাহিদা সচল থাকায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হারে। করোনা-পরবর্তী বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে। বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রারম্ভেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতি পুনরায় চাপের মধ্যে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি গত বছর আগস্টে ৯ শতাংশ অতিক্রম করেছে। পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ৮-৯ শতাংশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মার্চে পুনরায় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। থিংক ট্যাংক সিপিডিসহ কয়েকটি বেসরকারি জরিপে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ২৫ শতাংশ এবং জ্বালানি মূল্যস্ফীতি ৪৫ শতাংশ বলা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বর্তমান সময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য প্রয়োজন বাজারে সাপ্লাই চেইনের অবাধ প্রবেশ ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণ। দেশে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা-ময়দা, এমনকি ফার্মের মুরগি ও ডিমের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে কতিপয় চিহ্নিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বাজারে প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনার জন্য সিন্ডিকেট ও একচেটিয়া ব্যবসা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। অনুরূপভাবে কৃষিজ পণ্য যেমন চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মরিচ, সবজি প্রভৃতিতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও সড়কের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চাহিদায় লাগাম টানা সব সময়ই একটি ভালো অস্ত্র। আমাদের দেশে চলমান ‘নয়-ছয়’ সুদের হার বিশেষ করে ঋণ প্রদানের সুদ ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকার ফলে অপরিকল্পিত বিনিয়োগ, খরচ এবং অপচয় উৎসাহিত করে। ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতিতে আমানতের নিম্ন সুদহার (৬-৭ শতাংশ) যেমন সঞ্চয় নিরুৎসাহিত করে তেমনি ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণপ্রাপ্তি ব্যক্তিঋণ প্রসারিত করে অতিরিক্ত চাহিদার সৃষ্টি করেছে। সস্তা ঋণ পাওয়া সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে ব্যবসায়ী শ্রেণি আশানুরূপ বিনিয়োগ বাড়াতে পারেনি, বরং খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার বেড়েছে। ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে ঋণের সুদহার বাড়লেও ব্যবসার ক্ষেত্রে ঋণের সুদহার বাড়েনি। যেকোনো তদবির ও চাপের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সুদহার সমন্বয় করা জরুরি। তবে দেশের অর্থনীতিকে একেবারে ঝুঁকিমুক্তও বলা যাবে না। ২০০৯-১৯ দশকে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছিল। করোনা মহামারি, মন্দার অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভৃতি বৈশ্বিক প্রভাবে প্রান্তিক মানুষের আয় কমে যাওয়ায় দারিদ্র্যের হার পুনরায় ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বিবিএসের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) জুন ২০২১ প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয় রেকর্ড ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও আমদানি ব্যয় ছিল ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঋণাত্মক লেনদেনের ভারসাম্য মেটাতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বড় রকমের টান পড়েছে যা ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-এর ডিসেম্বরে ৩২ বিলিয়নে নেমে আসে। আইএমএফের হিসাবে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি ও লেনদেনের ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে আইএমএফের কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণপ্রাপ্তির ব্যবস্থা হয়েছে, যার প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে স্থিতি তা উদ্বেগজনক না হলেও ক্রমান্বয়ে তা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতা ও দেশে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। স্বার্থান্বেষী একটি মহলের মুনাফালোভ ও কারসাজির ফলে ডলারের অতিমূল্য আরো তীব্র হয়েছে। গত ১ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় রেকর্ড ১০ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে বাজারে ছেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার উৎস হিসেবে রফতানি আয় ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স আমাদের প্রধান খাত। গত বছর জুলাইয়ের পর থেকে প্রবাসী আয় নিম্নগামী হলেও সদ্যসমাপ্ত মার্চ ২০২৩ সালে তা বেড়ে ২০২ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। রফতানি আয় এ মাসে কিছুটা কমলেও সার্বিকভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) রফতানিতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপের আরও একটি কারণ হচ্ছে একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলার বিদেশে অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচার। এসব স্বার্থান্বেষী দেশদ্রোহী মানুষের অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় করা জরুরি। ব্যাংক ব্যবস্থার খেলাপি ঋণ এখন দেশের আরও একটি বড় সমস্যা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, বড় বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছে। বেশকিছু ঋণ খেলাপি হওয়ার পেছনে ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তা, পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির দুর্বলতাও দায়ী। এ ব্যাপারে সংশোধনমূলক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। কয়েকটি উন্নত দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও কোনো ব্যাংক দেউলিয়া বা বিপর্যয়ে পড়লে সামাল দেয়া কঠিন হবে। এ অবস্থায় যেকোনো মূল্যে ব্যাংক ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করে অরাজকতা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে বাজেট ঘাটতি কমানো, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো এবং সরকারি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে বাজেট ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমাদের আশার দিকটি হচ্ছে দেশে কৃষি ও শিল্পোৎপাদন হচ্ছে, যদিও জ্বালানি সংকটে কখনও কখনও উৎপাদনে ব্যাঘাত হয়। খাদ্য মজুদ ও সরবরাহের সংকট নেই। প্রায় ১৯ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ থাকার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহ ও আমদানির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ সত্ত্বেও দেশে ভোগ চাহিদা বর্তমান থাকায় অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে যায়নি। সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সত্ত্বেও দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্রমে বাড়ছে। বর্তমান অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশ হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে বিশাল জনগোষ্ঠীর ভোগবৃদ্ধি, তরুণ শ্রমশক্তি ও তার মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ, কৃষি ও শিল্প খাতে বিনিয়োগ এবং মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়। তাছাড়া দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিদের সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় সহায়তা এবং টিসিবির মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি লোককে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা সংকট নিরসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন করে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মানদণ্ডে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিপুলভাবে স্বীকৃত। ২০২২ সালে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে ৩৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৭ সালে বাংলাদেশ ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশের এ অগ্রগতির পেছনে রয়েছে সরকারের স্থিতিশীলতা, সার্বক্ষণিক তদারকি ও দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা। তবে আমাদের দেশের আরেকটি নাজুক সমস্যা হলো একশ্রণির লোকের গুজব রটানো এবং দেশে-বিদেশে এ মর্মে নেতিবাচক প্রচারণা যে দেশের মানুষ ভালো নেই, অর্থনীতি ডুবে যাচ্ছে, অনেক মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে এবং ধার-কর্জ করে সংসার নির্বাহ করছে, বাংলাদেশ পাকিস্তান-শ্রীলংকার মতো সমস্যায় নিপতিত হচ্ছে ইত্যাদি। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি সংকটের মধ্য দিয়ে কালাতিক্রম করলেও অতিরঞ্জিত নেতিবাচক প্রচারণা নেই। এ ব্যাপারে আমাদের সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সংকট মোকাবিলায় দেশের জনগণ, ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা ও রাজনীতিবিদদের সততা ও দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করতে হবে।