কালের কড়চা

বিশ্বে খাদ্য সংকটের সতর্ক বার্তা

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি’র) প্রধান মিন্ডি ম্যাকেইন বিশ্বকে খাদ্যের জোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন। তার এই মন্তব্যের কারণ রাশিয়া-ইউক্রেনের শস্যবিষয়ক চুক্তির মেয়াদ ১৮ মে শেষ হওয়া। এই চুক্তি শেষ হওয়ার ফলে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও শস্যচুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। খাদ্য কর্মসূচির প্রধান এ চুক্তিটি নবায়ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। তা নাহলে গোটা বিশ্বই খাদ্য সংকটে পতিত হবে। খাদ্য সংকট বিশ্বের মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাশিয়া-ইউক্রেন খাদ্যশস্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। বিশেষত ইউক্রেনকে ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয়ে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শস্যের জোগান দিতে পারছে না দেশটি। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের শস্যচুক্তিতে বলা আছে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো কিয়েভকে ব্যবহার করতে দিতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই বন্দরগুলো অবরোধ করে রেখেছিল রাশিয়া। রুশযুদ্ধ জাহাজ দিয়ে ঘেরাও ছিল বন্দরগুলো। চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কথা থাকলেও চুক্তিটি আর আলোর মুখ দেখতে নাও পারে, এমন হুমকি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে বিশ্বে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় গত ২০২২ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া খাদ্যশস্য চুক্তিটি করেছিল। এর বিনিময়ে মস্কোর কৃষিজ পণ্য রপ্তানিতে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ছিল জাতিসংঘের।

‘সূর্যমুখি বীজ’, গম, বার্লিসহ বিপুল শস্য রপ্তানি করে থাকে ইউক্রেন। চুক্তির ফলশ্রুতিতেই ইউক্রেন এসব পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছে। বিশ্বে খাদ্য শস্যের চাহিদার প্রায় অর্ধেকই আসে ইউক্রেন থেকে। তাই চুক্তিটি নবায়ন করা না হয়, তবে বিশ্বে খাদ্য শস্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। যে জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান খাদ্য সংকটের সতর্কবার্তা প্রদান করেছেন।

এমনিতেই কোভিড-১৯ অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে গোটা বিশ্বই হিমশিম খাচ্ছে। উপরোন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মন্দা অর্থনীতিকে আরও বেগবান করছে। বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়লে সুস্থ রাজনীতিও নির্বাসিত হয়। রাজনীতি ও অর্থনীতি একটি অপরটির পরিপূরক। এ বাস্তব সত্যকে সব রাজনৈতিক নেতাদেরই উপলব্ধি করা প্রযোজন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। খাদ্য পণ্যের বাজার মূল্যস্ফীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজারেও নেমেছে ধস। ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান এ যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতিই অনেকটা ভেঙে পড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য রয়েছে। দেশ দুটোতে তৈরি পোশাক, পাটসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আবার গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পতিত হয়নি কিংবা খাদ্য সংকটেও পড়েনি, তারপরও শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশেষত খাদ্যপণ্যের বাজারকে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যদি রাশিয়া-ইউক্রেন শস্য চুক্তিটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা না হয়, খাদ্যঝুঁকিতে পড়ে যাবে গোটা বিশ্বই। কেননা, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে যে শস্য রপ্তানি হয় তা দিয়ে শিশু খাদ্যও তৈরি করা হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও যে চুক্তিটি সাধারণ মানুষের কল্যাণ বয়ে এনেছিল তা বিস্ময়কর। এখন শঙ্কিত এ কারণে যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শস্য চুক্তির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান অবস্থান। চুক্তির শুরুতেই তিনি এর বিরুদ্ধেই ছিলেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে চুক্তিটি সম্ভব হয়েছিল। এখন আবার নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনিতেই যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন ও রাশিয়া পণ্য উৎপাদনে সমস্যায় পড়েছে দেশ দুটোর কৃষি বিভাগ ও সাধারণ কৃষকরা।

এদিকে কিয়েভকে সুরক্ষিত করতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য।

গত ফেব্রুয়ারিতে ২০২৩ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলনস্কি ব্রিটেন সফর করেন। সে সময় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার বোমা ও ইরানীয় ড্রোনের হামলা থেকে কিয়েভের নিরাপত্তা প্রয়োজন।’ এদিকে ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। কৃষি এলাকাও হামলা থেকে বাদ যায়নি। জানা গেছে, মাটিতে গোলাবারুদ ও আকাশ পথে বিমান হামলা একসঙ্গে দুটিই চালায় রুশ সেনাবাহিনী। আঘাতে ইউক্রেনের খারকি নামক জায়গার ৬টি বাড়ি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। খেরসন এলাকার প্রশাসন জানিয়েছে গত ১২ ও ১৩ মে’র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৯০ বার গোলাগুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছে। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ স্থাপনা অন্যান্য লক্ষ্যে আঘাত হানার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে আসছে রাশিয়া। এসব হামলা ঠেকানোর জন্য পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সহায়তা করতে যেসব অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দিয়েছে তার মধ্যে প্যাট্রিয়ট সিস্টেম অন্যতম। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা প্রাথমিক বরাতে জানিয়েছেন যে, ‘সাম্প্রতিক রুশ হামলায় ইউক্রেনে ব্যবহৃত যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা একটি প্যাট্রিয়েট ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম সম্ভবত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ ‘ক্ষতিগ্রস্ত সিস্টেমটি মেরামতের সেরা উপায় নিয়ে ওয়াশিংটন কিয়েভের মধ্যে আলোচনা চলছে।’ তবে প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হবার খবরটি কিয়েভ প্রত্যাখ্যান করেছে।

যা হোক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে শেষ হবে এর কোনো ঠিকঠিকানা নেই। উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, রাশিয়া-ইউক্রেন ও দীর্ঘস্থায়ী ষংঘাত, যা ২০১৪ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল। শুরু হয়েছিল ক্রিমিয়ার অবস্থা ও দনবাসের কিছু অংশকে কেন্দ্র করে। যে অংশকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হয়, আন্তর্জাতিকভাবে তা ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। তারপরও ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ চলছে ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধ সামনে রেখেই বিশ্ব নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা যায়! বিশ্বের সভ্য কোনো মানুষই যুদ্ধের পক্ষে নয়। যুদ্ধ কখনও শান্তি দিতে পারে না। তারপরও কেন যুদ্ধ হয়? সে প্রশ্নটি থেকেই যায়। আমার নানাভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি বটে; কিন্তু কোনো ব্যাখ্যায়ই যুদ্ধের হিসাব মেলাতে পারছি না। গত ২টি বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, কী লাভ হয়েছে?

এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি আরও কিছু রাষ্ট্রের যুদ্ধ আমরা লক্ষ্য করছি- যেমন ইসরাইল-ফিলিস্তিনি, আবার সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি লক্ষ্যণীয় এমনি অবস্থায় খাদ্য সংকট তৈরি হবেই। রাশিয়া-ইউক্রেন শস্যচুক্তিই একমাত্র শঙ্কার কারণ নয়। বিশ্বের খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে কানাডাভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজওয়াল ক্যাপিটালিষ্ট আরও তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হচ্ছে (১) ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান, (২) বিশ্বব্যাপী সারের ঘাটতি ও (৩) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে ফসল উৎপাদনে প্রতিকূল আবহাওয়া। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় গোটা বিশ্বকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। বিশ্বে চাষ উপযোগী অনাবাদি ভূমিতে কৃষিচাষের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে পর্যাপ্ত কৃষি উপযোগী জমি অনাবাদি পরে রয়েছে। জনবলের তথা কৃষিজীবীর অভাবে সেখানে কৃষি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজনে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ থেকে লোকবল নিয়ে কৃষি উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য চাই ঐকমত্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বৈরি আবহাওয়া তৈরি হয়েছে, সে জন্য দরকার কার্বন নিঃসরণ গতিরোধ। প্রতি বছরই জলবায়ু সম্মেলন হয়; কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবরূপ লাভ করতে পারে না। প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ রক্ষায় সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। নদীমাতৃক দেশে নদী খাল বিল সংরক্ষণ করতে হবে। বিশ্বের উৎপাদিত পণ্যের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। খাদ্য সংকট মোকাবিলা এখন প্রত্যেক রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংকটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। মানব জাতি ইচ্ছা করলেই সব সমস্যা সমাধান করতে পারে।