গত ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রি. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেছেন। সেই থেকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত জনগণের সেবা দিচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল। উদ্বোধনের পর থেকে সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চললেও জনগণের প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে উত্তরা থেকে মানুষের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দিয়াবাড়ি পর্যন্ত উত্তরা উত্তর স্টেশনের পর গন্তব্য পরিবহনের অভাব রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দিয়াবাড়ি থেকে আজমপুর অথবা উত্তরা হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত মেট্্েরারেলের সংযোগ থাকলে গাজীপুর থেকে মিরপুর কিংবা মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াতের সুলভব্যবস্থা হতো। ব্যাপকসংখ্যক জনগণের সুবিধা নিশ্চিত করা যেত। মতিঝিল, শাহবাগ, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আগারগাঁও থেকে মিরপুর হয়ে যারা উত্তরা, আজমপুর-টঙ্গী-গাজীপুর যেতে আগ্রহী, তারা উত্তর স্টেশনের পর গন্তব্যে পৌঁছতে অন্য পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে নারাজ। প্রথম থেকেই বিষয়টি ভাবার দরকার ছিল।
গত ৩০ এপ্রিল ২০২৩ এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর পর থেকে লক্ষ্য করছি অসংখ্য পরীক্ষার্থী মেট্রোরেল ব্যবহার করছে। জ্যামহীন টেনশন মুক্তভাবে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। চোখে মুখে ছাত্রছাত্রীদের তৃপ্তির রেশ। এমন ভাবনাহীন ঢাকার সড়কপথ কল্পনা করা যায় না। আগারগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসা এক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলো। পল্লবী থেকে মেয়েকে নিয়ে আসা সাদিয়া আফরিন জানালেন, পল্লবী থেকে বাসে আগারগাঁও আসতে ১ ঘণ্টার বেশি সময় হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হতো। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের জ্যাম ঠেলে কাজিপাড়া-শ্যাওডাপাড়া দুটো বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে আসা খুবই কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল। কিন্তু এখন ১০ মিনিটে পল্লবী থেকে আসা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিশ্বাস করতে পারি না। বাংলাদেশে আছি কি-না। একজন অভিভাবক এমন ক্লান্তিহীন সন্তুষ্টির কথা যখন জানালেন, তখন প্রধানমন্ত্রীর একটি কথা মনে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মেট্রোরেল প্রকল্প যখন শুরু করি অনেকে বলেছে ‘লস প্রজেক্ট’। এতো টাকা খরচ করে মেট্রোরেলের কোনো দরকার ছিল না।’ নিন্দুকেরা হয়তো এটা বুঝে না সরকারকে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে অনেক সময় লস প্রজেক্টও হাতে নিতে হয়। যদিও মেট্রোরেল কোনোভাবেই লস প্রজেক্ট না।
আগামী জুলাই মাসে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল যাতায়াত শুরু হলে এই বাহনটি হয়ে উঠবে একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। অফিসপাড়া হিসেবে খ্যাত মতিঝিল থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ফার্মগেট, নাখালপাড়া, রাজাবাজার, আগারগাঁও, শ্যামলী, কল্যাণপুর, গাবতলী, কাফরুল, মিরপুর, উত্তরা পর্যন্ত চলাচল করবে। সড়কপথের জ্যাম পরিহার করে মেট্রোরেলকেই এই অঞ্চলের মানুষ সাদরে গ্রহণ করবে সন্দেহ নেই। আধুনিক এ যোগাযোগমাধ্যমটির বদৌলতে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সময়ের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর থেকে চাপ কমে যাবে। জ্যামে বসে অস্থির চিত্তে ভাবতে হবে না, অফিসে বিলম্বের কারণে বসের বিরাগভাজন হওয়ার। হাসপাতাল কিংবা জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে সহজেই সময়ের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। শ্রম ঘণ্টা নষ্ট না হওয়ার কারণে সময়ের ব্যবহার বাড়বে। অর্থনীতি ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে নিঃসন্দেহে। অফিস বা প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি অনুসরণ করা সহজ হবে।
তবে মেট্রোরেলের নাগরিক সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। স্টেশনের সিটিজেন চার্টারের অপ্রতুলতা চোখে পড়েছে। প্রথমেই আসি স্টেশনে কনকোর্স হল নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার বিষয়। একজন যাত্রী কীভাবে বুঝবে সে কোনদিকে যাবে- উত্তরার দিকে, নাকি মতিঝিলের দিকে। সঠিক নির্দেশনা চিহ্ন নেই। কনকোর্স হলে ওঠার পর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়তে হয় যাত্রীদের। এ্যারো চিহ্ন দিয়ে স্পষ্ট করতে হবে। কোনদিকে গন্তব্য। দ্বিতীয়ত, টিকিট কাউন্টারে কিউ করে দাঁড়ানোর কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে যথেচ্ছাভাবে লোকজন টিকিট কাউন্টারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। এটি একদিকে দেখতে অশোভন অন্যদিকে বিব্রতকরও বটে। তৃতীয়ত, যাত্রীরা নিরাপত্তা গেট দিয়ে ঢুকে ট্রেনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে সামান্য বিলম্ব হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ ট্রেনের দরজায় লিফটের মতো সেন্সর দেয়া নেই, ফলে দুই দিক থেকে আসা দরজার চাপে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি। সে কারণে নিরাপত্তা বেষ্টনির দরজা আগে বন্ধ করে তারপর ট্রেনের দরজা বন্ধ করা উচিত। চতুর্থ, বিষয়টি হচ্ছে ট্রেনের এনাউন্সমেন্ট। বারবার এতো শব্দ করে ঘোষণা দেয়া হয় যা শব্দদূষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘোষকের উচ্চারণ এবং টিউন আরও সুন্দর সাবলিল শ্রুতিমধুর হওয়া উচিত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোরেলের মধ্যে সুগন্ধি স্মেল যাত্রীরা আশা করতেই পারে। কনকোর্স হল বা প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের বসার জন্য কাঠের তৈরি বা সিরামিক্স জাতীয় বেঞ্চ থাকলে সুনাম বাড়বে। আশা করি, কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন।