পর্যালোচনা

সমৃদ্ধি অর্জনে জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো বাস্তবায়নের গুরুত্ব ও করণীয়

এ কে এম এ হামিদ, উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যে কোনো দেশ বা জাতিরাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক বিকাশ এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে অবশ্যই ওই জাতিরাষ্ট্রের গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণের মানভেদে যোগ্যতার স্তর নির্ণয়ের জন্য জাতীয় যোগ্যতার সুনির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। এ ধরনের স্তর বিন্যস্ত কাঠামো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন আনয়নের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক হাতিয়ার। শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের এই স্তর বিন্যাসকে সাধারণভাবে জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো বা কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বের ১৫০টি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ জনশক্তিকে শ্রেণিবিন্যস্ত কর্মীবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কোথাও ৮টি, কোথাও ১০টি যোগ্যতা কাঠামো স্তর বিন্যাস প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে। প্রতিটি দেশ নিজস্ব শিক্ষা ও দক্ষতার স্তর বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে লেভেল-১ এবং ডক্টরাল শিক্ষাকে লেভেল-৮ বা ১০ নির্ধারণ করে অন্য শিক্ষাকে প্রয়োজন বিবেচনায় ১ থেকে ৮ বা ১ থেকে ১০ স্তরে বিন্যাস করা হয়। উল্লেখ্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় মানসম্মত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক একটি মৌলিক হাতিয়ার।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাঙ্ক্ষিত আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান শিক্ষাদর্শন দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়িত না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আইডিইবি থেকে স্বাধীন দেশোপযোগী উন্নয়ন উৎপাদন ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। তৎপ্রেক্ষিতে বিগত ১৭ জুলাই ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক (বিকিউএফ) প্রণয়নের নির্দেশনা ও ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাগিদ প্রদান করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ অক্টোবর ২০১৮ বিকিউএফ প্রণয়নের লক্ষ্যে ২১ সদস্য বিশিষ্ট বিকিউএফ স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে। ওই স্টিয়ারিং কমিটির ১২/১১/২০১৮ তারিখের সভায় দেশের সব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বমূলক ৭টি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করা হয়। দীর্ঘ সময় পরে হলেও বৈশ্বিক চাহিদা ও অংশীজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রায় ১ বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কামামো (বিএনকিউএফ) নাম অনুমোদন করে এবং চূড়ান্তকৃত বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো (বিএনকিউএফ)-কে গত ১২ মার্চ ২০২৩ তারিখে চালু করার ঘোষণা প্রদান করে।

এই কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক বা যোগ্যতা কাঠামোতে শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অভিন্ন রেখে মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, দক্ষতা বা অকুপেশনাল যোগ্যতা এবং উচ্চ শিক্ষা, এই তিনটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাখা হয়েছে জীবনব্যাপী শিক্ষার অবারিত সুয়োগ; যা হতে পারে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিক। শিক্ষার এই স্তরসমূহে সব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিপরীতে একজন ব্যক্তির যে জ্ঞান, দক্ষতা ও দায়িত্ব থাকা উচিত, তা সাধারণভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন থেকে যায়, বিএনকিউএফ প্রণয়নে যেখানে দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর সময় নেয়া হয়েছে, সেখানে এটি বাস্তবায়নে কত বছর অপেক্ষা করতে হবে?

বিএনকিউএফের সুবিধাগুলো : যদি বিএনকিউএফ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে (১) দেশের সামগ্রিক জনবলের চাহিদাভিত্তিক ফোরকাস্টিং ও শ্রেণিবিন্যস্ত জনবলের ডাটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এই পরিকল্পিত জনশক্তি যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প-কারখানা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের জন্য সহজ হবে। (২) স্টেকহোল্ডার হিসেবে দেশের এমপ্লয়াররাও শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক নিয়োগ, উৎপাদন ও উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারেবে। এর উপকারভোগী হবে শিক্ষকসমাজ, অভিভাবক, পেশাজীবী ও পলিসি মেকার তথা গোটা জাতি। (৩) দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অনুযায়ী ২০৩০ সালে যে ১২ কোটি কর্মক্ষম জনবল পাওয়া যাবে, সেই বিশাল জনশক্তিকে দেশের ওয়ার্কফোর্স ফোরকাস্টিং অনুযায়ী পরিকল্পিভাবে জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক ক্লাসিফাইড ওয়ার্কফোর্স হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। (৪) রাষ্ট্র সমগ্র কর্মক্ষম জনশক্তিকে দেশে-বিদেশে ক্লাসিফাইড ফিউচার রেডি ওয়ার্কফোর্স হিসেবে জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারবে। ফলে একদিকে জাতীয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে বিদেশে দেশের জনশক্তিকে সম্মানজনক কাজে পাঠাতে পারবে ও তৎপ্রেক্ষিতে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ। (৫) এমপ্লয়রা তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বেতন ভাতা নির্ধারণ বা বৃদ্ধির জন্য বিএনকিউএফকে যোগ্যতার মাপকাঠি বা একটি ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করবে এবং বিএনকিউএফের অধীন সনদপ্রাপ্তদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে পারবে। (৬) যেহেতু কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক একটি কাঠামোগত মান নিশ্চিতকরণ ও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ইনস্ট্রুমেন্ট, সেহেতু জনবল নিয়োগে এখন আর সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে না। সরাসরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটদের বৃত্তি বা পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রোডাক্টিভ ওয়ার্কফোর্স পেয়ে যাবে। (৭) অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা সিলেক্টিভ কাজ বা পেশা নির্বাচনের সুযোগ পাবে। তাই বিএনকিউএফের আওতায় পরিচালিত কোর্স ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হয়ে কাঙ্ক্ষিত লেভেল থেকে সার্টিফাইড কর্মী হিসেবে সংশ্লিষ্ট শিল্পে নিয়োগ পাওয়া সহজতর হবে। (৮) দেশের শিল্প-কারখানাকে যুক্ত করে শিক্ষা ও দক্ষতার গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম হবে কম্পিটেন্সি বেইজড বা আউটকাম বেইজড। ফলে উন্নয়ন উৎপাদন ও শিল্প-কারখানায় প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি পাবে। (৯) শিক্ষার্থীরা যে সনদ অর্জন করবে তা ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিদেশে পেশার স্বীকৃতি পাবে এবং রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক স্বীকৃতি সহজ হবে।

দেশের বর্তমান ও আগামীর সমগ্র জনবল এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও কর্মজীবনের পরিকল্পনা ও বিকাশ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মান নিশ্চিত করতে এবং উন্নয়ন উৎপাদনের কর্মক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পেশার জন্য যথার্থ যোগ্যতার স্তর চিহ্নিত ও অর্জনে বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো শুধু সহায়কই হবে না, বরং রাষ্ট্র ও জনগণ উপকৃত হবে।

বিএনকিউএফের বিভিন্ন স্তরের জ্ঞান, দক্ষতা ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সাধারণ মানদণ্ড ঃ বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কের (বিএনকিউএফ) ১০টি স্তরের মানদণ্ড সাধারণভাবে বিন্যাসিত হয়েছে। স্তরগুলো হলো- স্তর ১ : এই স্তরটি মৌলিক শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। এর মধ্যে রয়েছে সহজ শব্দ ও বাক্য পড়ার এবং লেখার ক্ষমতা, মৌলিক গাণিতিক গণনা সম্পাদন করা এবং সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা; স্তর-২ : এই স্তরটি নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান, যেমন ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক অধ্যয়ন ও কলা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ স্তর মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ, সমস্যা সমাধান এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার মৌলিক দক্ষতা থাকতে হবে; স্তর ৩ : এই স্তরটি নিম্ন মাধ্যমিক পরবর্তী স্তরের সাধারণ মাধ্যমিক, ভোকেশনাল মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার দাখিল স্তরের শিক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে মাঝারি জ্ঞান ও একই সঙ্গে যোগাযোগের মাঝারি দক্ষতা, সমস্যা সমাধান এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মূলত এ স্তরে শিক্ষার্থীদের মৌলিক বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার কথা বলা হয়েছে; স্তর ৪ : এটা শিক্ষার উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম স্তরকে নির্দেশ করে। যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে অধিকতর উচ্চতর স্তরের জ্ঞান এবং একই সঙ্গে উচ্চতর যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যা সমাধান এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীদের উচ্চতর বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকার কথাও বলা হয়েছে; স্তর ৫ : এই স্তরটি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সমাপ্তি স্তর ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সুপারভাইজারি দক্ষতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। উচ্চ মাধ্যমিক সাধারণ ও ভোকেশনালসহ আলিম সনদধারী শিক্ষার্থীরা এই স্তরে উচ্চ শিক্ষায় গমনের জন্য বা উচ্চতর পেশাগত কাজে কার্যকর অংশগ্রহণের কর্মপরিকল্পনা করার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচিত; স্তর-৬ : সব মধ্যম স্তরের পেশাগত ডিপ্লোমা এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত। এটি মাধ্যমিক-উত্তর টারশিয়ারি শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এই স্তরটি মূলত কারিগরি শিক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। মধ্যম স্তরের ব্যবস্থাপক হিসেবে এই স্তরে উত্তীর্ণ গ্রাজুয়েটরা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের দক্ষ কর্মী ও উচ্চস্তরের পেশাজীবী ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করবেন। কর্মস্থলের ছোট ছোট দল বা গ্রুপকে পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও রোজ রোজ ঘটে না- এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রত্যাশিত মনুষ্য বা যান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে এই স্তরের জনবলকে পারদর্শী হতে হবে। মধ্যম স্তরের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য এই শিক্ষার্থীদের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিশেষ দক্ষতাসহ বিশ্লেষণধর্মী উচ্চতর তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে; স্তর-৭ : ব্যাচেলর ডিগ্রি স্তর হিসেবে নির্ধারিত। এ স্তরে শেখার ফলাফলের মানদণ্ডের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে উচ্চতর জ্ঞান ও দক্ষতা, সেই সঙ্গে গবেষণা ও বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববাস্তবতার পরিস্থিতিতে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগের সক্ষমতা থাকা আবশ্যক। পেশাগত শিক্ষায় এই স্তরের স্নাতকরা উচ্চতর মধ্যম স্তরের পেশাজীবী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে; স্তর ৮ : স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা স্তর। এ স্তরে শেখার ফলাফলের মানদণ্ডের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অধিকতর উচ্চতর জ্ঞান ও দক্ষতা, সেই সঙ্গে উন্নত গবেষণা এবং বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের গবেষণার ফলাফলগুলোকে সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করার ও জটিল পরিস্থিতিতে জ্ঞান প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকতে হবে বলা হয়েছে; স্তর ৯ : মাস্টার্স ডিগ্রি স্তর। শেখার ফলাফলের মানদণ্ডে মূলত গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জটিল গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা ও পরিচালনা করার এবং গবেষণার ফলাফলগুলো স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন এই স্তরের অর্ন্তভুক্ত; স্তর ১০ : ডক্টরাল ডিগ্রি স্তর। শেখার ফলাফলের মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে মৌলিক গবেষণা পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়া ও একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সক্ষমতা। শিক্ষার্থীদের গবেষণা ফলাফলগুলোকে সমালোচনামূলকভাবে মূল্যায়ন করার এবং গবেষণার ফলাফলগুলো সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত।

বিএনকিউএফ বাস্তবায়নে করণীয় : বিএনকিউএফ যোগ্যতার স্বীকৃতি ও গুণমান নিশ্চিত করার জন্য একটি প্রমিত ব্যবস্থা, যা জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রসার ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই সুবিধাগুলো একটি দক্ষ এবং অভিযোজনযোগ্য কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে, যোগ্যতার গুণমান ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে এবং যোগ্যতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে সাহায্য করতে পারে। বিএনকিউএফের গুণগতমান নিশ্চিতকরণে বিশেষ কিছু বিষয়কে অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যোগ্যতার প্রমিতকরণ, যোগ্যতার শ্রেণিবিভাগ ও স্বীকৃতির জন্য একটি সাধারণ কাঠামো প্রদান। এটি যোগ্যতা মূল্যায়নে বৃহত্তর স্বচ্ছতা ও ধারাবাহিকতার জন্য একটি বিধান; যা যোগ্যতার গুণগতমান ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। এটি ক্রমাগত শেখার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করবে এবং টেকসই ও দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এনকিউএফকে আন্তর্জাতিক যোগ্যতার কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ডিজাইন করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে যোগ্যতার স্বীকৃতিকে সহজতর করবে। বিদেশে কাজ করতে বা অধ্যয়ন করতে চাওয়া ব্যক্তিদের পাশাপাশি বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত যোগ্যতার স্বীকৃতির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

বিএনকিউএফ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। যার মধ্যে- (১) এ জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, মোটিভেট করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিক পার্টানারশিপ জোরদার করতে হবে, প্রয়োজনীয় প্রচুর সাপোর্টিং লিগ্যাল ডকুমেন্ট প্রণয়ন করতে হবে। (২) ২০১২ সালে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসিফিকেশন অব অকুপেশন (BSCO) নামে বিবিএস একটি অকুপেশনাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে ১০টি মেজর, ৪৩টি সাবমেজর, ১৩৭টি মাইনর ও ৪৬৩টি ইউনিট গ্রুপ এবং প্রতিটি ইউনিট গ্রুপের আওতায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অনেক অকুপেশন বা পেশা। বিএনকিউএফকে বিএমসিও সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। (৩) এছাড়াও, Recognition of Prior Learning ধারণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষায় যুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং আরপিএল যেন যথারীতি বাস্তবায়ন হয়, সে দিকে জোর দিতে হবে। (৪) বিএনকিউএফের ফলে জীবনভর শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। (৫) বিএনকিউএফের সফল বাস্তবায়ন করতে হলে ইন্ডাস্ট্রি-ইনস্টিটিউট-গভর্নমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে পার্টারশিপ/কোলাবোরেশন নিশ্চিত করতে হবে। (৫) বিএনকিউএফ জাতীয়ভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিএনকিউএফ এনএসসি (ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি) জাতীয় অ্যাপেক্স বডি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিএসির কার্যপরিধি বিস্তৃতি করে অথবা অনুরূপ আরেকটি অ্যাপেক্স বডি গঠনপূর্বক বিএনকিউএফ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। (৬) ২০১২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ভোকেশনাল কোয়ালিফেশন ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়ে আসছে এবং ইতোমধ্যে প্রায় ২ লাখ অকুপেশনাল সনদধারী বের হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এখনো তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শ্রীলঙ্কা ২০০০ সালে তাদের কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়ন শুরু করে। মাত্র ৪ বছর পরই এই ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সনদপ্রাপ্তদের নিয়োগের জন্য সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। কিন্তু বাংলাদেশ ২০১২ সালে এনটিভিকিউএফ বাস্তবায়ন শুরু করে। তবে, এই সনদপ্রাপ্তদের নিয়োগ, পদোন্নতি বা প্রণোদনার কোনো সার্কুলার এখনো প্রকাশ করা হয়নি বা এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে অতি শিগগির সরকারি নির্দেশনা জারি করতে হবে। (৭) একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর যথেষ্ট পরিমাণ গ্র্যাজুয়েট বের হলে শুধু যোগ্যতা কাঠামোর অধীনে সনদপ্রাপ্তদেরই নিয়োগ করার বিধান জারি করতে হবে। এটা না করলে শিক্ষার্থী বা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো এই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে আগ্রহী হবে না। (৮) দেশের শিল্প-কারখানাকে যুক্ত করে শিক্ষা ও দক্ষতার কোয়ালিটি নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা মান বা কারিক্যুলাম হবে কম্পিটেন্সি বেইজড বা আউটকাম বেইজড। ফলে উন্নয়ন উৎপাদন ও শিল্প-কারখানায় প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি পাবে। (৯) দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সমাপনান্তে যে সার্টিফিকেট ইস্যু করবে, তাতে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি বিএনকিউএফ লেভেলটি উল্লেখ করতে হবে, যাতে দেশে বিদেশে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজতর হয়।

সর্বোপরি, এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, গতানুগতিক অন্যান্য মানদণ্ড আইন বা বিধান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে যে ধরনের অনিয়ম বা প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়, বিএনকিউএফ অনুসৃত করার ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত হবে না। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতীয় দক্ষতা কাঠামো প্রণীত হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে অংশীজনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও অংশীজনের সমন্বিত প্রয়াস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিএনকিউএফের সফল বাস্তবায়ন করতে হলে শিল্প-ইনস্টিটিউট-সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে অংশীদারিত্বমূলক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। আশা করছি, সংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করবেন।