প্রকৃতি-পরিবেশ

দূষণে সভ্যতা হুমকির মুখে

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মহাবিজ্ঞানী স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন এ বিশাল জগৎ। Big Bang- অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবীসহ সব কিছুরই সৃষ্টি হয়। তারপর এক সময় পানির উপর ভাসমান ‘প্লটোপ্লাজম’ থেকে প্রাণের সৃষ্টি ঘটে। প্রাণী জগতের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার জন্য ধীরে ধীরে রচিত হয় ‘নিঃসর্গ-সংসার’। সব সৃষ্টিই বিজ্ঞানের কার্যকারণ সূত্রে গাঁথা-মহান সৃষ্টি কর্তার দান।

‘বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর উপরিভাগের মাটির আবরণ যদি আর মাত্র কয়েক ফুট পুরু হতো, তাহলে পৃথিবী অক্সিজেন শূন্য হয়ে যেত। আর অক্সিজেন থাকত না মানেই আমাদের আর বাহাদুরি দেখাবার কিছু থাকত না। অনেকে আরও বলেন, পৃথিবী তার অক্ষদণ্ডের উপর ঘণ্টায় ১ হাজার মাইল বেগে ঘুরছে। এ ঘূর্ণনের বেগ কমে গিয়ে যদি ঘণ্টায় একশত মাইল হতো, তাহলে এক একটা দিন বা রাত্রি দশ গুণ করে বেড়ে যেত, অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা দিন ১২ ঘণ্টা রাত না হয়ে ১২০ ঘণ্টা করে হত। ফলে ভয়ানক অসুবিধায় পড়তে হত আমাদের। যেমন গরমে সূর্যের তাপে অনেক গাছপালা মরে যেত আর শীতকালের ঠান্ডায় সব জমাট বেঁধে যেত।

কোনো কোনো বিজ্ঞানী আরও বলেন, সূর্যের উপরিভাগের তাপমাত্রা ২ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মত। সূর্যের তাপ যদি তার অর্ধেক হতো, তাহলে আমরা ঠান্ডায় সব জমে যেতাম। আবার যদি তাপমাত্রা ডবল হয়ে যেত, তাহলেও পুড়ে হতো সব ভস্ম।

বিজ্ঞানীদের অনেকে বলেছেন, চন্দ্র পৃথিবী থেকে ২, ৩৮, ৪৫৭ মাইল দূরে অবস্থিত। চন্দ্র যদি পৃথিবী থেকে আরও ৫০ হাজার মাইল দূরে সরে যেত, তাহলে অনেকের মতে পৃথিবী প্রত্যহ দুবার সমুদ্রের জোয়ারে প্লাবিত হত এবং পর্বত পর্যন্ত ধ্বংস হত। বিজ্ঞানীদের মতে, মহাসাগরগুলো যদি আরও কয়েক ফুট করে গভীর হতো- তাহলে পৃথিবীর ওপর থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড লোপ পেয়ে যেত। তার ফলে পৃথিবীতে কোনো গাছপালা জš§াত না।

তারা আরও বলেন, পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রত্যেহ রাইফেলের গুলির চেয়েও দ্রুতগতিতে কোটি কোটি উল্কা বর্ষিত হয়, তারমধ্যে দুই কোটি উল্কা পৃথিবীর ভেতরে ঢুকতে চায়। কিন্তু একটা পুরু বায়ুমণ্ডল দিয়ে পৃথিবীকে পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে উল্কাগুলো বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে জ্বলে যায়, আর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বায়ু সমুদ্রে হয়ে যায় নিঃশেষ। যদি পৃথিবী পর্যন্ত সব উল্কাগুলো এসে পড়তে পারত, তাহলে লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি জায়গায় সর্বদা আগুন জ্বলত। আলোর গতি হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতগামী, আলো ২৫ সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল ছুটতে পারে।

মনুষ্যজাতির অনুকূল পরিবেশ রচনা করতে সৃষ্টি করা হয়েছে, আনুপাতিক গাছগাছালি আর বায়ুমণ্ডল। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভূখণ্ডের শতকরা ৩০ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বননীতি হলো সমতলে ৩৩ ভাগ এবং পার্বত্য অঞ্চলে ৬৩ ভাগ বনভূমি রাখতে হবে। ১৯৫০ সাল থেকে আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগেই বন মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু এসব অনুষ্ঠান নিছক যেন তিথি পালন। বনানীকরণের খানিকটাও অগ্রগতি লক্ষিত হচ্ছে না।

বৃক্ষলতাহীন যান্ত্রিক জীবন অস্বাস্থ্য ও নানা ধরনের ব্যাধির প্রকোপে ব্যতিব্যস্ত হচ্ছে। অগণিত বৃক্ষ ছেদনের ফলে অনেক অঞ্চলই বৃক্ষলতার পর্শহীন পাষাণপুরী। নগরজীবন বৃক্ষ বিরল হয়ে আসায় মানুষের প্রাণের অস্তিত্ব আজ সংকটাপন্ন। কার্বন ডাই-অক্সাইড-এর ব্যথা বিষে মানুষ নীল-কণ্ঠ। ঢাকা শহরেই নাকি বায়ুমণ্ডলে ১৩০০ মেট্রিক টন দূষিত কণা উড়ে বেড়াচ্ছে, তা থেকে শহরতলির শিল্পাঞ্চলের অবস্থা কল্পনা করা যায়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের বিজ্ঞানীরা সুর তুলেছেন- পরিবেশ দূষণের রাহু গ্রাস থেকে বাঁচতে হলে তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতেই হবে।

নাগরিক সভ্যতার বিষবাষ্পে রুদ্ধশ্বাস কবি বড় দুঃখ করে বলেছেন- দাও ফিরাইয়া সে অরণ্য লও এ নগর। বৃক্ষ মনুষ্য জীবনের অমূল্য স¤পদ। হিসেবের এক অংক কষে দেখা গেছে- একটি গাছ যদি ৫০ বছর বেঁচে থাকে, তাহলে তা থেকে প্রাণদায়ী অক্সিজেনসহ মোট ২৫ লাখ টাকা সমপরিমাণ সুবিধা পাওয়া যায়। একটি অঞ্চলে গাছপালার অভাবেই বৃষ্টিপাতের তারতম্য দেখা দেয়। আমাদের সমতল দেশের শতকরা ৩৩ ভাগের জায়গায় মাত্র ৬ ভাগ বনাঞ্চল রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতির বিরূপ মনোভাবের স¤মুখীন। এ দেশবাসীকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অনেক বেশি করেই সচেতন হতে হবে। ঐকান্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকৃতির শ্যামল প্রান্তর থেকে খুঁজে নিতে হবে জীবনের সে কল্পতরু। গাছপালাহীন মরু অঞ্চলে জীবন যেমন শুকিয়ে যায়- তেমনি প্রকৃতির শ্যামলিমায় জীবনের বীজ প্রস্ফুটিত হতে থাকে। এক নতুন শক্তিতে পাঁপড়ি মেলতে থাকে।

আমাদের দেশের প্রতিটি শহরেই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের বড়ই অভাব। কিন্তু অন্যান্য দেশগুলোতে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাদি রাখা হয়। মানুষকে বাঁচাতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী তরুলতা-গাছপালাকে বাঁচাতে হবে। কবি ঠিকই বলেছেন- ‘God Made Villages, men made towns’ অর্থাৎ গ্রামগুলো আল্লাহর সৃষ্টি আর শহরগুলো মানুষের হাতের গড়া। দেখা গেছে, যেখানেই মানুষ সৃষ্টির উপর হস্তক্ষেপ করেছে, অত্যাচার করেছে, সেখানেই প্রকৃতি বিরূপ হয়ে তার উপর নিয়েছে নির্মম প্রতিশোধ। জীবনের সুস্থতা-সুন্দরতা উপভোগ করতে হলে তরুরাজির শ্যামল স্নিগ্ধ আশীর্বাদের অমৃত ধারায় অবগাহন করতেই হবে। তরুরাজির বন্দনায় কবিগুরুর নন্দন বাণী- ‘তব প্রাণে প্রাণবান/তব স্নেহছায়ায় শীতল, তব তেজে তেজীয়ান/সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব তারই দূত হয়ে/ওগো মানবের বসু, আজি এ কাব্য অর্ঘ্য লয়ে/শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ করি আমি অর্পিলাম তোমায় প্রণাম।’

তরুলতা গাছ-গাছালি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যক্ষভাবেই কত না প্রয়োজনে লাগে- তা একটি পরিসংখ্যান থেকে আঁচ করা যায়। বর্তমান বিশ্বে গাছ থেকে প্রায় ১০ হাজার রকমের অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। এগুলোর অধিকাংশই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে থাকি। ইউনানি-হোমিওপ্যাথ-আয়ুর্বেদিক ওষুধ কো¤পানি যে ওষুধ প্রস্তুত করে সবই গাছ-গাছড়ায় নির্মাণ।

প্রাচীনকালের তপোবন- সভ্যতা মনুষ্য জীবনে বৃক্ষলতার অপরিসীম গুরুত্ব অনুভব করেছিল। পীর ফকিরদের আস্তানা, মুনি ঋষিদের সাধনাস্থল, শিক্ষাশ্রম ইত্যাদি প্রকৃতির উদার উন্মুক্ত অঙ্গনের মাঝখানে স্থাপিত হত। তপোবন- কন্যা শকুন্তলা তো একান্তভাবেই প্রকৃতি দুহিতা। শকুন্তলার সুখে-দুঃখে প্রকৃতি আনন্দিত ও কাতর হত। শকুন্তলার বিরহে যেন তপোবনের তরুলতা এক অন্তহীন শূন্যতায় মুহ্যমান হয়ে পড়ত। মানুষ ও প্রকৃতির এমন একাকারতা- সহমর্মিতা- সংবেদনশীলতা বিশ্বে আর কখনও শোনা যায়নি।

রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একদা সে আদর্শকেই বাস্তবে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যেই তিনি সবুজ বনানীতে আচ্ছাদিত শান্তিনিকেতনেই ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই কবি বৃক্ষরোপণ উৎসবের পরিকল্পনা করেন। কবিগুরু প্রায়ই বলতেন- ‘আমার অনেকদিনের সংকল্প জ্ঞান- অনুশীলনের একটা হাওয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করতে ছাত্রদের মন আপনিই অলক্ষিতভাবে বিকাশ লাভ করতে পারবে।’

হজরত ইবরাহিম (আ.) মহান স্রষ্টার কাছে অনাবাদি জমি আবাদ করার প্রার্থনা করেছিলেন। হজরত মুসা (আ.) প্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন একটি গাছের নিচে। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদ (সা.) নিজের হাত দ্বারা বৃক্ষরোপণ করে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তার কথাটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। নবী (সা.) বৃক্ষরোপণকে অত্যন্ত পুণ্যের কাজ এবং অনর্থক বৃক্ষের ক্ষতিসাধন করাকে পাপ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নবীজি বলেন- যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষরোপণ করে অথবা শস্যবপন করে উহা যদি কোনো মানুষ, পাখি অথবা পশু খায়, নিশ্চয় উহা রোপণকারীর জন্য দানরূপে গণ্য হবে। (বোখারি শরিফ)। বুদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা বুদ্ধদেব গাছের নিচেই সাধনা করে ‘বুদ্ধত্ব’ অর্জন করেছিলেন। নৈসর্গিক ছায়া-সুনিবিড় তরুচ্ছায়ায় বসেই বাল্মীকি মুনি একদিন তার দুই শিষ্য রামচন্দ্রের পুত্রদ্বয়কে রামায়ণের গান শিখিয়েছিলেন।

মানুষের সার্বিক মঙ্গলের জন্য পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। পরিবেশকে প্রদূষণমুক্ত রাখতে হলে গাছগাছালিকে আর ধ্বংস না করে নতুন করে এগুলোর বংশ বিস্তারে আমাদের একান্ত উদ্যোগী হতে হবে। এটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। এ দায়িত্বকে সামাজিক আন্দোলনরূপে গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষকে এ কাজে লাগাতে হবে এবং অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে বেঁচে থাকার ‘জীবন আন্দোলনের’ অনন্য ভূমিকায়। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে ১৯৯৭ সালে পরিবেশ আইন প্রণয়ন করা হয়। রয়েছে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। একান্ত সরকারি উদ্যোগেই পরিবেশ সংক্রান্ত আইনগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।

এবার বায়ুমণ্ডল প্রসঙ্গে আসা যাক। বায়ুমণ্ডলের নিম্নাঞ্চলে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের ৪০ হাজার ফুট উপর পর্যন্ত গ্যাসীয় পদার্থের যে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটুক না কেন, তা মূলত বায়ুদূষণ সমস্যায় জড়িত। বায়ুমণ্ডলের এ নিচের অংশে বাতাসের স্বাভাবিক উপাদানগুলো অক্সিজেন ২০.৯৪ শতাংশ, নাইট্রোজেন ৭৮.০৯ শতাংশ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ১.০৩ শতাংশ, ওজোন, জলীয় বাষ্প, ক্রিপটন, আর্গন এবং অন্যান্য গ্যাস। এছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন কিছু গ্যাসীয় পদার্থ। স্বাভাবিক উপাদান ছাড়া অন্য কোনো পদার্থ বাতাসে উপস্থিত থাকলে, সেগুলোকে বলা হয় দূষিত বর্জ্য পদার্থ। এছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন কিছু গ্যাসীয় পদার্থ। স্বাভাবিক উপাদান ছাড়া অন্য কোনো পদার্থ বাতাসে উপস্থিত থাকলে, সেগুলোকে বলা হয় দূষিত বর্জ্য পদার্থ। এগুলো জমা হতে হতে যখন একটা ঘনত্বে চলে আসে, তখন এগুলোকে বলা হয় প্রদূষণকারী পদার্থ। দূষিত পদার্থের সংখ্যা বেশ বড়।

শহরে যন্ত্রচালিত যানবাহন থেকে নিঃসৃত পোড়া গ্যাস বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করছে। দেশের প্রায় সব শিল্প-কারখানা বায়ুদূষণের যে জোগান দিয়ে চলেছে, এগুলোর মধ্যে থার্মাল পাওয়ার জেনারেশন, সিমেন্ট উৎপাদন, অয়েল রিফাইনিং, সব ইস্পাত শিল্প, প্লাস্টিক ও সার শিল্প, মেশিনশপ, কেমিক্যাল প্রসেস ইত্যাদি বিশেষভাবে বায়ুদূষণ করে চলেছে। বাষ্পীয় দূষণ বস্তুর মধ্যে আছে, মানব দেহের পক্ষে ক্ষতিকারক অক্সাইড অব নাইট্রোজেন ও সালফার, কার্বন- ডাই- অক্সাইড, মনোক্সাইড, হাইড্রোকার্বন ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও রয়েছে শব্দ ও পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়জনিত দূষণ। অতিরিক্ত বায়ুদূষণ থেকে ব্রংকাইটিস, ব্রংকিয়েল অ্যাজমা, প্লুরিসি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি কঠিন রোগ দেখা দেয়। গবেষণাগারে ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তাতে দেখা গেছে- জীবাণু দ্বারা ফুসফুসে আক্রান্ত যে কয়েকটিকে সালফার ডাই-অক্সাইড, ওজন ও শহরের দূষিত বাতাসের সংস্পর্শে রাখা হয়েছিল- ওদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল এবং শরীরের অ্যান্টিবডি অর্থাৎ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দূষণ অধ্যুষিত অঞ্চলে যারা বাস করেন- তাদের নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও হাঁপানি রোগ বেশি হওয়ার ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৮০- ৮৪ এ বছরগুলোতে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্ব সংস্থার নির্ধারিত মান ১৩০ অতিক্রম করে গেছে। পাঁচটি বড় শহর চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এর বাতাস মারাত্মকভাবে দূষিত। এ শহরগুলোতে বাতাসে ভাসমান দূষিত কণিকার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের তিনগুণ বেশি। বিশ্ব ব্যাঙ্ক পরিচালিত সাম্প্রতিক ‘বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি’-এর সমীক্ষা অনুসারে দেখা গেছে- বছরে বায়ুদূষণের ফলে প্রায় ৫ হাজার গর্ভপাত ও অকাল মৃত্যু হয়।

আমাদের পল্লি অঞ্চলের আবাসিক এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে ঘন ঘন ইট ভাটা ও চিমনি ভাটা, যা গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাসকেও করছে দূষিত-কলুষিত। চিমনি ভাটার পাশের এক বাড়ির বৃদ্ধা একদিন কাশতে কাশতে এ নিবন্ধককে বললেন- বাবা, আমার তো কোনো দিন হাঁপানি হয়নি- এ বছর হয়েছে। ডাক্তার নাকি বৃদ্ধাকে বলেছেন- পাশে থাকা চিমনি ভাটার বায়ুদূষণের ফলেই তার এ মরণাপন্ন অবস্থা। সুতরাং এখন থেকে আমাদের এ ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এমন স্থানে স্থাপন করতে হবে, যাতে তার চারদিকে প্রচুর উন্মুক্ত জায়গা থাকে। কল-কারখানা চিমনি, নিঃসৃত ধোঁয়া, জঞ্জাল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব শিল্প আইন আছে- তার অনুপুঙ্খ বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দেশে বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বায়ুদূষণ প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা রকম বুরুশ ও ফিলটার ব্যবহার করা হয়। শোষণ ও নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় বায়ুদূষণ রোধ করা অনেকটা সহজতর। দূষিত বস্তুগুলোকে একত্র করে বিভিন্ন পদার্থের একটা বড় অংশ একটু চেষ্টা করলেই বাদ দেয়া মোটেই কঠিন কাজ নয়। সবচেয়ে সহজসাধ্য ও কার্যকর ব্যবস্থা হলো- গাছ লাগানো। এ গাছগুলোই দূষিত বায়ুর পরিশোধক। পরিবেশ দূষণের প্রতিকার মোটেই দুঃসাধ্য নয়। আসলে যা প্রয়োজন- তাহলো এ ব্যাপারে প্রণিত আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। বড়ই দুঃখের কথা, এ ব্যাপারে আমাদের দেশে কল- কারখানা- শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বিস্ময়করভাবে নির্বিকার। ফলে আইনের প্রয়োগ কঠিনভাবেই করতে হবে।

পরিবেশ দূষণ মানুষের গড়া সভ্যতার অন্যতম কুফল। যান্ত্রিক সভ্যতার যেসব বিষধর ফণা চারদিকে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে, তাদের মধ্যে পরিবেশ দূষণ অন্যতম। বর্তমানে সামান্য সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের প্রলোভনে চিরকালের জন্য স্রষ্টার সাজানো-গোছানো নিসর্গিক সংসার বিনষ্ট করে আমরা আত্মঘাতী নীতিই গ্রহণ করছি। আমাদের এ আত্মঘাতী নীতির প্রতিফলন শুধু বর্তমান মানব জাতিই ভোগ করছে না, ভাবী প্রজন্মকেও বিপন্ন করে তুলছে। এ মুহূর্ত থেকে আমরা যদি পরিবেশ দূষণের প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণে ব্রতী না হই- তবে মহান স্রষ্টার নিষ্কলঙ্ক বিশ্বকে কলঙ্কিত- কলুষিত করার দায়ভার আমাদেরই বহন করতে হবে। সুস্থ পরিবেশের অপর নামই জীবন। সেই জীবনকে যথাসময়ে রক্ষা করতে এগিয়ে না এলে সভ্যতার গোরস্তানে পড়ে থাকবে, আমাদের পচাগলা লাশ। এরপর প্রতিকারের হয়তো কেউ থাকবেই না।