ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনার নব্য সম্পর্কের সম্ভাবনা

সুমাইতা আফনান, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনার নব্য সম্পর্কের সম্ভাবনা

ফুটবল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। কিন্তু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাই যেন হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব ঘুচিয়ে দুই দেশকে কাছে নিয়ে এসেছে। তাই তো প্রতি বছরের বিশ্বকাপে বাংলাদেশি সমর্থকদের আর্জেন্টিনা ও লিওনেল মেসির প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

এই অকৃত্রিম ভালোবাসারই প্রতিদান হিসেবে দীর্ঘ ৪৫ বছরের বিরতি শেষে পুনরায় বাংলাদেশে সূচনা ঘটেছে আর্জেন্টিনার দূতাবাসের। পুনরায় বলার কারণ, ১৯৭৪ সালে ঢাকায় প্রথম আর্জেন্টিনার দূতাবাস স্থাপন করা হলেও ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার তৎকালীন সামরিক সরকার কর্তৃক ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে দূতাবাসটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে ফুটবল মৈত্রীই যেন দুই দেশের সম্পর্কের এই দীর্ঘ বছরের দূরত্বের অবসান ঘটিয়েছে। কেননা চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বনানীতে দূতাবাসের উদ্বোধন করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো। উদ্বোধনের সময় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো জানিয়েছেন যে, পুনরায় দূতাবাসের উদ্বোধন শুধু দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কই নয় বরং দুই দেশের জনগণের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে তিনি আশাবাদী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বোধনে উপস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে লাতিন আমেরিকার দেশটির কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে পৌঁছেছে। দুই দেশই তাদের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কেননা গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসেছিল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি টিম, যেখানে উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো. আমিন হেলালি। বৈঠকে মূলত দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য ভিসা সহজীকরণ, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের পক্ষে কীভাবে দেশটিতে সহজে যাতায়াত করা সম্ভব হবে সেই বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। এজন্যই উদ্বোধনী সফরের দ্বিতীয় দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো। অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি আশ্বাস দেন যে, এই সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি ও টিসিবি কর্তৃক সরাসরি খাদ্যপণ্য আমদানি করা যাবে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্জেন্টিনায় যেতে ভিসা প্রয়োজন না হলেও ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা চালু করার লক্ষ্যে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন। মূলত এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মূল উদ্দেশ্যই হলো উভয় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থার উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করা।

আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনায় পণ্য রপ্তানি হয় ৬৮ লাখ ৫৪ হাজার ডলার যার ৮৮ শতাংশেরও বেশি ছিল তৈরি পোশাক। ২০২২ সালে পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৫ লাখ ১৮ হাজার ডলারে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৯০ কোটি ডলারের ১২ লাখ টন পণ্য আমদানি করে আর্জেন্টিনা থেকে যার বেশির ভাগই কৃষি পণ্য যেমন- ভোজ্যতেল, ভুট্টা, গম, তুলা ইত্যাদি। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে একটি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় এলাকা। কেননা যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য, পর্যটন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া আমদানি বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ আর্জেন্টিনার যেসব খাতকে কাজে লাগাতে পারে সেগুলো হলো- পরিশোধিত জ্বালানি (পেট্রোলিয়াম, ইউরেনিয়াম ও লিথিয়াম), মোটর যন্ত্রাংশ, অলিভ অয়েল, গুঁড়া দুধ, রসুন, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কৃষি পণ্য, স্বর্ণের কাঁচামাল, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল। একই সঙ্গে আর্জেন্টিনার আমদানি বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে তৈরী পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ঔষধ, সিরামিক, প্লাস্টিক পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য।

তবে এসব সম্ভাবনার পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্কে বড় বাধা হতে পারে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। কেননা আর্জেন্টিনা বর্তমানে তাদের অর্থনীতিতে তিন দশকে প্রথমবারের মতো ব্যাপক হারে মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে দেশটিতে রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রার কারণে প্রধান রপ্তানি পণ্য- গম, ভুট্টা এবং সয়াবিনের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে; যার ফলে ২৮ শতাংশের মতো রপ্তানি কমবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আর্জেন্টিনার বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের সঙ্গে তৈরি হওয়া কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেই বিষয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তবে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বিবেচনা করলে আশা করা যায় সম্ভাব্য বাধাগুলো অতিক্রমপূর্বক কূটনৈতিক যোগাযোগ ফলপ্রসূ হলে বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার নব্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত