আপনাদের ভাবানা

তরুণরা কেন দেশ ছাড়তে চায়?

জিহাদ হোসেন রাহাত

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

লক্ষ্মীপুরের রিফাত শাহরিয়ার (ছদ্মনাম)। ২০২২ সালে শেষ করেছে এইচএসসি পরীক্ষা। বাবা পেশায় ব্যবসায়ী। ছোট একটি মুদি দোকান চালান স্থানীয় বাজারে। ব্যবসায়ের আয় দিয়ে সংসার চালানো দায়। রিফাত পরিবারের বড় সন্তান। ছোট দুই বোন অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালাতে বাবার কষ্ট দেখে রিফাত প্রায় প্রতিদিনই ভোগে দুশ্চিন্তায়। মাথায় একটা চিন্তাই ঘোরে- টাকা রোজগার করতে হবে। মনে ভাবনা আসে- দেশের আয়ে পরিবারের সার্বিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব! তাই সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাড়ি জমাবে প্রবাসে। দুঃখের বিষয় হলো, প্রবাসে যাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থাও নেই তার পরিবারের।

এসব বিষয় শুধু রিফাত একা ভাবে না- দেশের লক্ষ্য তরুণের মনেও জাগে একই ভাবনা। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি। অন্যদিকে চাকরির বাজারের বেহাল দশা। পড়াশোনা করেই বা কি হবে? এমন প্রশ্নও ঘোরে অনেক তরুণের মনে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে সংসার চালিয়ে নেয়ার মতো আয়ের উৎস কিংবা চাকরি খুঁজে পাওয়া বড় দায়। সামান্য আয়ে অনেকের সংসার চালাতে কষ্ট হলেও নিরুপায় হয়ে করতে হয় অল্প বেতনের চাকরি। দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথাই বলি। প্রতি মাসে একেকজন শ্রমিকের গড় আয় ৮-১০ হাজার টাকার বেশি না। এই পরিমাণ টাকায় এতোদিন টেনেটুনে সংসার ব্যয় নির্বাহ করা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে এসে পণ্য দ্রব্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।

দেশের মোট শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ তরুণ-তরুণী। তরুণীদের তুলনায় সাংসারিক চাপ তরুণদের ওপরেই বেশি হয়ে থাকে। ফলে পরিবার নিয়ে বেশি চিন্তা তরুণরাই করে। আবার পরিবারের বড় ছেলে হলে তো কথাই নেই। পরিবারের সব দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার উপরেই এসে পড়ে। ফলে অধিক চিন্তার কারণে তরুণরা খুঁজতে থাকে অধিক আয়ের পথ। আয়ের এই পথ খুঁজতে গিয়েই তারা আবিষ্কার করে- প্রবাস জীবন নামক গল্পের। ভাবতে থাকে- প্রবাসে যাওয়া মাত্রই ঘুরে যাবে ভাগ্য। সমাধান হবে পারিবারিক টানাপড়নের সমস্যার। ফলে দেখা যায় অনেক সময় নিকটাত্মীয়, ব্যাংক, জমি বিক্রি, বাসতভিটা বন্ধক কিংবা চড়া সুদে গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে। ধারদেনা করে বিদেশ গিয়ে তরুণদের পোহাতে হয় নানা রকম মানসিক যন্ত্রণা।

অবশ্য এসব সমস্যার বিষয় আগেই আঁচ করতে পারে অনেক তরুণ। তারপরও পরিবারের কথা চিন্তা করে ছাড়তে চায় দেশ।

তবে যে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারের ছেলে সন্তানরা আয়ের আশায় ছাড়তে চায় দেশ তা; কিন্তু নয়। পড়াশোনার স্বপ্ন নিয়েও অনেকে পাড়ি জমাতে চায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। একটা সময় ছিল, যখন দেশের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরাই বিদেশে লেখাপড়া করতে পারত। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। বর্তমান সময়ে এসে ফুল-ফ্রি স্কলারশিপে অনেকেই পড়তে যাচ্ছেন বিদেশে। স্কলারশিপ নিয়ে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যাচ্ছেন চীন, জাপান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইতালির মতো দেশগুলোয়। তরুণদের দেশ ছাড়তে চাওয়ার এটিও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।

আবার অনেক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা আয়েশি জীবনযাপনের আশায় পাড়ি জমাতে চান বিশ্বের উন্নত অঞ্চল কিংবা দেশগুলোয়। তারা কেন দেশ ছাড়ছে কিংবা ছাড়তে আগ্রহী চলুন খুঁজি সেই উত্তর- টানা বেশ কয়েকবার বিশ্বের দূষিত শহর হিসেবে দেশের রাজধানী শহর ঢাকার অবস্থান, তীব্র যানজট, দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি না হওয়া, সব সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি এমনকি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনগুলোয় শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হওয়াসহ বেশ কয়েকটি দৃশ্যমান সমস্যার কারণে দেশ ছাড়তে আগ্রহী তারা।

এখন প্রশ্ন হলো, দেশের উঁচু-নিচু সব শ্রেণির তরুণরা যদি দেশ ছেড়ে যায়, তাহলে কেমন হবে বাংলাদেশের অবস্থা? কারা নিবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব? কেমন হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ?

এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাও যেন দায়। দেশের জন্য প্রবাসীদের অবদানের বিষয়টি স্বীকার করে উল্লেখ করতে চাই, বহিঃবিশ্বের ওপর আমাদের অধিক পরিমাণে নির্ভর হওয়া ঠিক হবে না। দেশের তরুণদের দেশ ছাড়ার এসব কারণসহ বাকি সব সমস্যা চিহ্নিত করে অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নয়তো দেশের মেধা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করে দিলে- দেশের কোনো উপকার সাধন হবে না।

তরুণ কলামিস্ট

[email protected]