পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি
দারিদ্র্য-বাল্যবিয়ে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থী
প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। ছেলেমেয়ের শিক্ষা বাবদে নিম্নবিত্ত মানুষও যথেষ্ট বিনিয়োগের প্রয়াস চালায়। এক সময় লক্ষ্য করা যায়, নুন আনতে পান্তা ফুরায়- এমন অবস্থায় অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব হয় না শিক্ষা ব্যয়ভার বহন করা। তখন ঘটে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার মতো বিয়োগান্ত ঘটনা। এটা আমাদের শিক্ষা প্রসারে একটি পরিতাপের ঘটনা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়, যখন কষ্টেসৃষ্টে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় নিবন্ধন করেও শেষাবধি ঝরে পড়ে। এটাকে কেউ কেউ ভাগ্যের অভিশাপ মনে করে। আবার কোনো কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা বাল্যবিয়ে দিয়ে স্বস্তি বোধ করেন। দারিদ্র্যের বৃত্তে আটকে বাল্যবিয়ের মুখে পড়ে নীরবে প্রতিবছরই স্কুল ছাড়ছে অসংখ্য বালিকা। অন্যদিকে অভাবী ঘরের ছেলেরা সংসারের ঘানি টানতে কিশোর বয়সেই জড়িয়ে পড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। ফলে পড়াশোনায় পড়ছে ছেদ। এভাবে দশম শ্রেণিতে উঠেও অনেকের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা হচ্ছে না। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গত ২১ মে পর্যন্ত অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। যদিও পরীক্ষার বিষয় ও পত্রভেদে এ সংখ্যা কমবেশি হয়। আর ৩৮ হাজার অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে, ১১ হাজার ৩৮৩ জন।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুপস্থিতর এ সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। করোনার আগে ২০১৭ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ৮ হাজার ৫২০ জন। ২০১৮ সালে ৯ হাজার ৬৪২, ২০১৯ সালে ১০ হাজার ৩৮৭, ২০২০ সালে ১২ হাজার ৯৩৭, ২০২১ সালে ১৮ হাজার ৮২০ এবং ২০২২ সালে ৩৫ হাজার ৮৬৫। আর এ বছর ৩৮ হাজার অনুপস্থিতি ধরলে ২০১৭ সালের চেয়ে তা পাঁচ গুণের কাছাকাছি। প্রশ্ন জাগে, এমন কোনো ঘটনা ঘটল যে, করোনাকালের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার বদলে ঝরে গেল? সাধারণ পর্যবেক্ষণে দারিদ্র্য আর বাল্যবিয়ের কারণেই মূলত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষা থেকে দূরে থাকছে। অসুস্থতা ও পরীক্ষা খারাপ হওয়ার কারণে অনুপস্থিতির ঘটনাও আছে। এ ছাড়া খুব সামান্য কিছু শিক্ষার্থী কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার হওয়ার কারণেও পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে আর উপস্থিত থাকছে না। এগুলো কারণ বটে, তবে সংকট আরও গভীরে বলে প্রতীয়মান। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে করোনার মধ্যে দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়ে যায়। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয় প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। এই ঝরে পড়ার অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান জরুরি।
দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম আর আয় বৈষম্য সাধারণ মানুষকে এখন বড় ধরনের সংকটে ফেলেছে। এর মধ্যে করোনাকালের চাপ এখনও অনেকে কাটিয়ে ওঠছে পারেনি, এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও নাজকু করে তোলে। তবে এ চাপ আরও নমনীয় করা যেত যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে- বিদ্ব্যৎজনরা এমনই বলেন। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, টিকে থাকার ব্যয়ভার বহন করাই অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে শিক্ষাকে বাহুল্যই মনে হয়। আর্থিক সক্ষমতা থাকলেও কম মানুষই এখন বাল্যবিয়ে আগ্রহী হয়, কিংবা সন্তানকে শ্রমঘন কাজে জড়িয়ে ফেলে। ঘুরেফিরে বলা যায়, উন্নতির কথা যতই বলা হোক, দরিদ্রতা বৃত্তে এখনও অনেকে আটকে আছে। অথচ দারিদ্র্য কাটাতে গেলে শিক্ষাটাই আগে দরকার। এ সচেতনতা সাধারণ মানুষের অবশ্যই থাকা উচিত। তবে সরকারকে অবশ্যই শিক্ষাকে সর্বজনীন করা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।