ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অল্প পরিচর্যা ও স্বল্প খরচে কেনাফ চাষে অফুরন্ত সম্ভাবনা

কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, [email protected]
অল্প পরিচর্যা ও স্বল্প খরচে কেনাফ চাষে অফুরন্ত সম্ভাবনা

কেনাফ পাটের ন্যায় পরিবেশবান্ধব আঁশজাতীয় ফসল। উষ্ণমণ্ডলীয় ও অব উষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে আঁশ উৎপাদনের জন্য এ ফসল ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। উঁচু, নিচু, পাহাড়ি, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে বপন উপযোগী কেনাফ ফসলে পাটের চেয়ে নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। কেনাফ কাগজের মণ্ড, ব্লেন্ডেড কাপড়, টেক্সটাইল, বিল্ডিং উপকরণ, বায়োকম্পোজিট, তেল শোষক ও অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রায় পাট ও আঁশজাতীয় ফসলের অবদান প্রায় আট বিলিয়ন। দেশের জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ আর কৃষিতে তা ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাট ও আঁশজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বে পাট ও আঁশজাতীয় ফসলের উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা, পাহাড়ি এলাকার ঢালু জমি এবং উপকূলীয় ও চরাঞ্চল ফসলে উৎপাদনের উপযোগী নয় বা আউশ ফসলের জন্য লাভজনক নয়, এমন অনুর্বর জমিতেও অল্প পরিচর্যায় কেনাফ চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া দেশে যেসব এলাকায় সেচের ব্যবস্থা নেই, সেখানে ধানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি খরা ও জলাবদ্ধতা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ চাষ কৃষকের প্রথম পছন্দ। বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ কেনাফ উৎপাদনকারী প্রধান প্রধান জেলা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে কেনাফ ও মেস্তা চাষের মাধ্যমে আঁশ উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার বেল। যদিও আমাদের দেশের অনেক এলাকাতেই কেনাফ আঞ্চলিক ভাষায় মেস্তা হিসেবে পরিচিত। চলতি ২০২৩-২৪ পাট উৎপাদন মৌসুমে ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসল চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৯তম সভায় বেসরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যায়িত মানের ৫৭৬ টন কেনাফ বীজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিজেআরআই’র সহায়তায় কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলায় কেনাফ বীজ উৎপাদন সমিতি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে মোট বীজ উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যা প্রায় ৬১২ জন। দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত কেনাফ বীজ সঠিক সময়ে আবাদ করা সম্ভব হলে এ বছর কর্তিত জমির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে।

মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতো কেনাফের গুরুত্বও অপরিসীম। কেনাফ ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১০০ দিন সময়ের মধ্যে প্রতি হেক্টর কেনাফ ফসল বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। পৃথিবীর বহুদেশে কাগজের মণ্ড ও উন্নতমানের কাগজ ছাড়াও বহু মূলবান দ্রব্যসামগ্রী কেনাফ থেকে উৎপাদিত হয়। কেনাফ আঁশ পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পজাত দ্রব্য হিসেবে বোর্ড, জিও টেক্সটাইল চট, কম্বল, প্লেন পার্টস, মোটর কার পার্টস, কম্পিউটার পার্টস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য- শিকা, মাদুর, জায়নামাজ, টুপি, স্যান্ডেল এবং কাপড় চোপড় জাতীয় সোফার কভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, কুশন কভার, সাটিং সুটিং, পাঞ্জাবি, সোয়েটার ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ইনটেরিয়র ইনসুলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। কেনাফের খড়ি অধিক পানি শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় তা বেডিং মেটারিয়ালসহ জ্বালানি ও উন্নতমানের চারকোল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কেনাফের বীজ থেকে ঔষধি গুণ সম্পন্ন তেল পাওয়া যায়।

বাস্তব প্রয়োজনে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে উর্বর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে এবং পাট স্থানান্তরিত হচ্ছে প্রান্তিক ও অপ্রচলিত (লবণাক্ত, পাহাড়ি ও চরাঞ্চল) জমিতে। তা ছাড়া নগরায়ন, শিল্পায়ান ও বাড়তি জনসংখ্যার বসতবাড়ি নির্মাণে প্রতি বছর প্রায় ০.৭ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমি। কিন্তু দেশের দক্ষিণের খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল লবণাক্ততা ও খরাপ্রবণ এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে পাট উৎপাদন মৌসুমে (মার্চ-জুলাই) কোনো ফসল থাকে না বললেই চলে। খুলনার কিছু কিছু এলাকায় তিল চাষ হলেও বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা বা খরার ঝুঁকি রয়েছে। উপকূলীয় লবণাক্ততা, খরা ও এক ফসলি আমন পরবর্তী সময়ে পতিত জমিতে অথবা চর এলাকায় কেনাফ চাষের সম্ভাবনা ও উৎপাদিত বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গবেষণা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন বিভাগের গবেষক দল। বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২ ও এইচসি-৯৫ কেনাফ জাত নিয়ে গবেষণা শেষে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেখানে লবণাক্ততার জন্য পাটচাষ সম্ভব নয়, সেখানে অনায়াসেই কেনাফ চাষ সম্ভব এবং বীজের অঙ্কুরোদগম ও গাছ বৃদ্ধির সময় কেনাফ ৮ থেকে ১৪ ডিএস/মি. পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। গবেষণাগারে সফলভাবে কেনাফ খড়ি এবং আঁশ থেকে কাগজের মন্ড ও কাগজ এবং কেনাফ বীজ থেকে ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায় বলে দাবি করেছেন গবেষক দল। অনুরূপভাবে বিজেআরআই’র বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে কেনাফ চাষের সফলতা পেয়েছেন। লবণাক্ততা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত এই তিনটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে।

দেশের কৃষি পরিবেশ ও কৃষকদের চাহিদা বিবেচনায় গত ২ মার্চ ২০২৩ দ্রুত বর্ধনশীল, জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু, কাণ্ড ও গোড়া পচা রোগ প্রতিরোধী বিজেআরআই কেনাফ ৫ (ফাল্গুনী কেনাফ) জাতটি সারাদেশে চাষাবাদের নিমিত্তে ছাড়করণের অনুমোদন দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জাতটি পাটের মতোই আঁশ উৎপাদনকারী এবং মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি উন্নত জাত। জাতটি ছাতরা পোকা ও স্পাইরাল বোরার প্রতিরোধ করতে পারে, যা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত জাতগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অধিক ফলনশীল ও বায়োমাস সম্পন্ন এ জাতটি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে অনাবাদি ও অনুর্বর জমিও চাষাবাদের আওতায় আসবে এবং পাট চাষিরা অধিক লাভবান হবেন। ভারতীয় জাতের কেনাফ ফসলের পাতায় হলদে ছিটা রোগ তুলনামূলকভাবে বেশি সংক্রমিত হওয়া এবং গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হওয়ায় বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-৯৫, বিজেআরআই কেনাফ-৩ (বট কেনাফ) ও বিজেআরআই কেনাফ-৪ (লাল কেনাফ) সারাদেশে উন্নত জাত হিসেবে কৃষকের কাছে অধিক সমাদৃত।

কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও রংপুরের অঞ্চলের অগ্রগামী কৃষকরা কেনাফ ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বপন শুরু করেন, যাতে পরবর্তী সময়ে এ ফসল কেটে অনায়াসেই আমন ধান রোপণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু গাছে আগাম ফুল চলে এলেও কেনাফ ফসলের ক্ষেত্রে ফুল ঝরে পড়ে এবং ফলন ও আঁশের মান অপরিবর্তিত থাকে। অন্যদিকে টাঙ্গাইলসহ কিছু কিছু এলাকার কৃষকরা বোরো ধান কেটে বৈশাখ মাসের শেষের দিকে কেনাফ চাষ করে থাকেন। কাজেই কেনাফ ফসলের বপনকালীন সময় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং কৃষকরা সুবিধাজনক সময়ে কেনাফকে শস্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।

উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকাসহ দেশে ফসল চাষের অনুপযোগী প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি প্রতি বছর অনেকটাই পতিত পড়ে থাকছে। অথচ এসব জমিতে অল্প পরিচর্যা ও কম খরচে অধিক ফলনশীল কেনাফ চাষ করে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। বিদেশে প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন ইনটেরিয়র কাজের ইনসুলেটর হিসেবে কেনাফ আঁশের বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়াও জুটেক্স ও জিওটেক্সটাইল তৈরি এবং কেনাফ কাঠির ছাই থেকে চারকোল তৈরির নতুন সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় কেনাফ চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন দুয়ার খুলে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে বিস্তৃত সম্ভাবনাময় এ আঁশজাতীয় ফসল পতিত জমিতে আবাদ করতে পারলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শ্রমশক্তি ব্যবহার এবং বনজসম্পদের ওপর চাপ কমবে। পতিত ও প্রান্তিক জমিতে কেনাফ চাষাবাদের মাধ্যমে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত