কালের কড়চা

চীনের আধিপত্যবাদ ও আফ্রিকায় সামরিক ঘাঁটি

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ও বিশে^র পরাশক্তির দেশ চীন ক্রমান্বয়ে আধিপত্য বিস্তারে নানারকম কৌশল অবলম্বন করছে। সাম্প্রতিক দেশটির কৌশলী ভূমিকার দিকে লক্ষ্য রাখছে গোটা বিশ্ব। যদিও তারা শান্তির বাণী প্রকাশ করছে নিয়মিত। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও বিশ্ববাসী ইতোমধ্যেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। চীন প্রশান্ত মহাসাগর দখল প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের এই প্রতিযোগিতা জানান দেয় বিশ্বে একক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কোনো রকম পিছপা হতে রাজি নয় তারা। চীন প্রশান্ত মহাসাগর দ্বীপ ওয়ামে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে সাইবার হামলা চালিয়েছে। চীনের হ্যাকাররা এ ধরনের হামলা চালিয়েছে বলে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে প্রকাশ করেছে বিশে^র অন্যতম প্রযুক্তি সংস্থা মাইক্রোসফ্ট। বিষয়টিকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে। এ খবরটি জানিয়েছে এ এন আই। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এবং মাইক্রোসফট একটি রহস্যময় কোড শনাক্ত করেছে, যা গুয়াম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোথাও টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, চীনা সরকারের একটি হ্যাকিং গ্রুপ এটি করেছে। বন্দর এবং বিমান ঘাঁটিসহ গুয়ামের মার্কিন এই সামরিক ঘাঁটিটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এশিয়ায় কোনো অঞ্চল সংঘাতময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে এই ঘাঁটিটি ব্যবহার করবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো। তবে মাইক্রোসফট হামলাসংক্রান্ত বিষয়ে যে দাবি করেছে তা অস্বীকার করেছে বেইজিং। মাইক্রোসফটের এ দাবিকে চীন অপেশাদারসুলভ এবং বিকৃত তথ্য হিসেবে অভিহিত করেছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্মিলিত ফাইভ আইজ অ্যালায়েন্সের সহযোগিতায় এই হামলায় ব্যবহৃত মেলওয়্যার সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে মাইক্রোসফট। অ্যালায়েন্সের অংশীদাররা দাবি করেন, তারা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রদানকারী এবং করপোরেট ব্যবহারকারিদের কীভাবে মেলওয়ার শনাক্ত এবং অপসারণ করতে হয় সে সম্পর্কে জ্ঞান দেয়। মাইক্রোসফট বলছে ভবিষ্যৎ সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুপ্তচর বৃত্তি ও যোগাযোগকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য দূষিত ওই মেলওয়্যারটি ইনস্টল করা হয়েছিল। চীনা সাইবার গ্রুপ ভোল্ট টাইফুনকে এই হামলার জন্য দায়ী করা হয়েছে। এ ব্যাপারে, চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, ‘যে অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তার যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ এখানে অনুপস্থিত রয়েছে। কাজেই এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। যা হোক, চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যমিথ্যা যাচাই করার কোনো সুযোগ না খুঁজেও বলা চলে চীন ভয়ংকরভাবেই আধিপত্য বিস্তারে তৎপর হয়ে উঠেছে।

চীন আফ্রিকাতে সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি আফ্রিকান দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণের জালে আটকে ফেলার ফন্দি আঁটছে। ইতোমধ্যে ‘জিবুতি’ নামক ছোট দ্বীপ দেশটিকে ঋণের ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। এই জিবুতিতেই-২০১৭ সালে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে চীন। চীন পরিচালিত দোবালেহ বন্দরের পাশেই তাদের সামরিক ঘাটিটি অবস্থিত। বৈশ্বিক নেতৃত্বে চীন তার অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে অত্যন্ত কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের পথচলায় আফ্রিকায় বেশি করে সামরিক ঘাঁটি গড়ার দিকে নজর দিয়েছে চীন। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এসব তথ্য। জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালে ‘লুওমাহু’ নামের একটি জাহাজ পাঠায় চীন। এই জাহাজ মোতায়েনের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরা বলেছেন, এডেন উপসাগরে চীনের এক হাজার একশত ফুটের যে নৌযান মোতায়েন করা হয়েছে, তা যুদ্ধবিমান, যুদ্ধ জাহাজ কিংবা পারমাণবিক সাবমেরিন ঠেকাতে সক্ষম। এর বাইরে তানজিনিয়ায় চীন এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমুদ্র বন্দর পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন রণতরী রাখার উদ্দেশ্যেই তাদের এই চেষ্টা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারত মহাসাগরের চারদিকে সামরিক বিস্তৃতি বাড়াতে নানারকম পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে চীন। আফ্রিকার আরেকটি গরিব দেশ গিনিতেও সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে ফেলেছে। এটি তাদের আফ্রিকা উপমহাদেশে দ্বিতীয় সামরিক ঘাটি। গোটা আফ্রিকাজুড়ে চীনের প্রায় ১০ হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সব প্রতিষ্ঠান থেকে বার্ষিক ১৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫০ বিলিয়ন আয়ের লক্ষ্য মাত্রা নিয়ে চীন কাজ করে যাচ্ছে। সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে শানিত করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে চীন এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোকে টার্গেট করে অগ্রসর হচ্ছে। এসব দরিদ্র দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক এবং নিজ দেশীয় সম্পদ ভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে চীন। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর আফ্রিকা কমান্ডের প্রধান জেনারেল ‘স্টিফেন টাউনসেন্ড’ মার্কিন সিনেটরদের বলেছিলেন, ‘উত্তরের মৌরিতানিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণের নামিবিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এক সময় যা করেছিল সেই একই ভূমিকা পালন করছে চীন।’ নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, জনগণ ও তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার নামে মানবতাবিবর্জিত কাজ করে যাচ্ছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রকে টক্কর দেয়ার মতো বৈশ্বিক পরাশক্তি হয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চায় তারা। এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আফ্রিকার ২১টি দেশে সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে বেইজিং। অন্য কোনো দেশ সেখানে এত অস্ত্র বিক্রি করতে পারেনি। বিক্রি করা অস্ত্রের মধ্যে রুয়ান্ডার কাছে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, নাইজেরিয়ার কাছে সাঁজোয়া যান। রুয়ান্ডার মতো দরিদ্র দেশে ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রের কোনো প্রয়োজন না থাকলেও তা বিক্রি করতে সক্ষম হয় চীন। চীন সম্পর্ক ভালো রাখতে পুরোনো অকেজো সরঞ্জাম দানও করে থাকে অনেক ক্ষেত্রে। আফ্রিকায় চীন ঘাঁটি করার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে ভারত মহাসাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সরানো। এ জন্য আফ্রিকাকে ঘাঁটি গড়ার আদর্শ ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে চীন। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে চীন ভালো যা কিছু চায়, তার বিনিময়ে আফ্রিকার নেতারা ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য দর কষাকষি করতে পারেন। তবে চীনের কৌশল, তারা আফ্রিকা মহাদেশে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করতে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছে তা দেখানো। পাকিস্তানের মতো যে সব দেশের সঙ্গে চীনের রয়েছে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক সেই সঙ্গে রয়েছে একই রকম কৌশলগত স্বার্থ সেই সব দেশে চীন অতিরিক্ত সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যায়ে কার্পণ্য করবে না কখনো। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা অস্ত্রের প্রাথমিক বাজার হয়ে গেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের কাছে ৮ সাবমেরিন বিক্রির চুক্তিও রয়েছে চীনের সঙ্গে। চীন এখন বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির মোড়লগিরিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা অব্যাহত থাকলে মানবতা একদিন বিপন্ন হয়ে উঠবে- অতএব সাবধান।