ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জনজীবন

মানুষ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে স্বস্তি চায়

মো. মাঈন উদ্দীন, অর্থনীতি বিশ্লেষক, [email protected]
মানুষ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে স্বস্তি চায়

অনেক দিন থেকেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বাজার নিয়ন্ত্রণহীন ভোজ্যতেল, প্রয়োজনীয় সবজি, চিনি, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, আলুসহ দৈনন্দিন জীবন ধারনের প্রায় সবকয়েকটি পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। মূল্যস্ফীতিতে চরম ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। এ মূল্যস্ফীতি কেন সহনীয় পর্যায়ে নেই বা বাজার কেন স্থিতিশীল হচ্ছে না। এর কারণ শুধু করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণ নয়, এর পেছনে রয়েছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজী, অতি মুনাফাখোরী প্রবণতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসলা ইত্যাদি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটি কয়েক ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ-সুবিধা সরকার বিভিন্নভাবে দিয়ে গেলেও তার সুফল জনগণ পাচ্ছে না। তারা যে পণ্য উৎপাদন করে তার মূল্য নির্ধারণের সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যদি সহজ না হয়, সাবলীল ও আয়ত্তের মধ্যে না হয়, তাহলে উন্নয়ন অনেকের কাছে অর্থহীন। তাই মূল্যস্ফীতি প্রকোপ কমিয়ে আনতে হবে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা গোড়া এখন নিয়ন্ত্রণহীন। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা জনগণ মুখে বলতে না পারলেও তাদের ক্ষোভকে বুকে চেপে ধরে নাভিশ্বাস জীবন অতিবাহিত করছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালি কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার। প্রতি ভোগ্যপণ্য মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলেগেছে। যাদের কিছু সঞ্চয় আছে তাও তারা ভেঙে ফেলেছে। এ অবস্থায় চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। কোনো কোনো পণ্যের সরবরাহ বাজারে প্রচুর দেখা গেলেও দাম কমছে না। এটা বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা। কিছু কিছু পণ্যের দাম সরকার বেঁধে দেয়ার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। পণ্য মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অজুহাতের শেষ নেই। একেক সময় একেক অজুহাত তারা দাঁড় করায়।

এ চিত্র বদলাতে হবে। সাধারণ মানুষকে ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হলে চলবে না। সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে জোরদার করতে হবে, প্রয়োজনে সংখ্যা বাড়াতে হবে। একটি দেশে সামগ্রিক উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই মুখ্য। একটি দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা ঝুঁকিগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। পত্রপত্রিকা ও অর্থনীতি বিশ্লেষক দের নানা মন্তব্য থেকে বলা যায়, দেশ ভয়াবহ ৫টি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি অন্যতম একটি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কমার পূর্ভাবাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। এদিকে বিগত ৭ বছরের মধ্যে এখন রিজার্ভ ও সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। ২৪ মে ২০২৩ এ রিজার্ভ ক্রমে ২ হাজার ৯৯৬ কোটি ৮৮ লাখ ৩০ হাজার ডলারে নেমে আসে। এর আগে ৮ মে এশিয়ার ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধের পর রিজার্ভ ক্রমে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গিয়েছিল। অথচ ৭ বছর আগে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৫ কোটি ডলার। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় থেকে রিজার্ভ ডলার জমা কম হওয়ায় এবং এল সি দায় মেটাতে ডলার বিক্রির বাড়ার কারণে রিজার্ভ কমেছে। তবে আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে প্রবাসিদের পাঠানো রিমিট্যান্স রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান। আমাদের শিল্প উৎপাদনের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আমদানির দায় ডলারের মাধ্যমে বেশির ভাগ শোধ করতে হয়। সেজন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যেসব পণ্য আমদানি হয় তার বড় অংশ দেশে উৎপাদন করতে হবে। এতে আমদানির উপর চাপ কমবে। ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি কম হলেও সংকট প্রকট হবে না। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি ক্রমে কমে আসার সুযোগ তৈরি হবে।

পণ্য মূল্যকে সাধ্যের মধ্যে রাখতে হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে। এজন্য আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। দেশে প্রয়োজনীয় নিত্য পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। বাজেট এর সুযোগ রাখতে হবে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে হলে পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন ও ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর পথ সহজ করতে হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবহন, ভ্যাট, শুল্ক, সহনীয় পর্যায়ে রাখার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি ও শিল্প। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম জনগণের সাধ্যের মধ্যে রাখতে হলে কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনে জোরদার করতে হবে। সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির চরম ভোগান্তি থেকে বাঁচতে হলে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে রক্ষণশীল হতেই হবে। খাদ্য সরবরাহসহ নিত্যপণ্য কম দামে সরবরাহ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি পণ্য উৎপাদনের পর তা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্টোরেজ করে সংরক্ষণ করতে হবে। টিসিবিকে ব্যবহার করে বা বাজার মনিটরিং জোর দার করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি সমাধান নয়। দ্রব্যমূল্যকে মানুষের সাধ্যের মধ্যে বজায় রাখার জন্য একটি স্থায়ী সমাধান বের করতে হবে। এজন্য কৃষির উৎপাদন আধুনিকিকরণ করা ও সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা উচিত। বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, এ ভর্তুকির সঠিক ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছতার সহিত মনিটরিং করা উচিত। ২০২২-২৩ বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি ধরা হয় ১৬ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে (২০২৩-২৪) কৃষিতে ভর্তুকি ১৭ হাজার কোটি টাকা থাকছে। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিও গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা চাই। দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ তাদের প্রায় সময় প্রেসার, ডায়েবেটিস, কিডনি, হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হয়। তাই তাদের খাদ্য দ্রব্যের চেয়ে বেশি জরুরি ওষুধপত্র ও চিকিৎসাসেবা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে প্রবীণ ও অসুস্থ, রোগগ্রস্ত লোকজন নানা সংকটে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সাধারণভাবে মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। নিম্ন আয়ের মানুষ যা আয় করছে তার পুরোটাই জীবন ধরনের জন্য ন্যূনতম খাদ্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিক্ষার ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরি জীবন কাটিয়েছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় কারণ চাকরি জীবনের একমাত্র সঞ্চয়, পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকা। তাদের অনেকে সঞ্চয়পত্র কিনে মাসে মাসে সেখান থেকে মুনাফা নিয়ে জীবন নির্বাহ করেন। ইদানীং সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ও কমানো হয়েছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীসহ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের অধিকাংশেই মানবেতর জীবনযাপন করছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখীভাব আর কতদিন জনগণ দেখবে।

বিবিএস তথ্য মতে, গত বছর আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ যা গত ১১ বছরের সর্বোচ্চ। তারপর থেকে ৮-৯ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে। এ বছর এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ২০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। জ্বালানি তেলের মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। শ্রীলংকা ও পাকিস্তান ছাড়া এশিয়ার কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো এতো মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী অবস্থান দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্য, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল ও গ্যাস, সার প্রভৃতির যে দাম সে তুলনায় আমাদের দেশের বাজার মূল্য অনেক বেশি। আমাদের দেশের চালের বাজারে গেলে দেখা যায় বর্তমানে মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৬ থেকে ৫০ টাকা সরু চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ডিমের ডজন ১৩০ থেকে ১৪৫ টাকা, ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। তাই গত এপ্রিলে কেজি প্রতি দাম ছিল ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা। চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪৮ টাকা। আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও মসলার দাম আবারো বেড়ে চলেছে। এভাবে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে মানুষের আয় সে হারে বাড়ছে না। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের সংকট আরও বেশি। তারা সন্তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। কমে যাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান। নিত্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বমুখিতা থেকে জনগণ মুক্তি চায়। তাই এ থেকে উত্তোরণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ করা, গরিব ও অসহায়দের স্বল্পমূল্যের খাদ্য বিতরণ এবং বিদ্যুৎ গ্যাস ও কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো উচিত। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমুখি দাম থেকে জনগণ তাদের সাধ্যের মধ্যে যেন থাকে, সেদিকে নজর দেয়া উচিত। ২০২৩-২৪ বাজেটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি কমানো। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি উৎপাদন রপ্তানিকারক, ভোক্তাসহ সবার জন্য ক্ষতিকর। তাই এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত