ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ব্যাংক ব্যবস্থা

খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কবে

রেজাউল করিম খোকন, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে কবে

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির খেলাপি ঋণ প্রায় ১১ শতাংশ। এরপরই অবস্থান বাংলাদেশের, খেলাপি ঋণ প্রায় ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের দেশ নেপাল। দেশটির খেলাপি ঋণ ২ শতাংশের কম। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক আপডেটে এসব কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ আমদানি ব্যয়, ঋণগ্রহীতাদের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। আর এক বছরে (এপ্রিল ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণী অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই এখন খেলাপি। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। কম সুদে ঋণপ্রাপ্তি ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল গত বছরেও। চলতি বছর থেকে ছাড় পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে, তবে বহাল আছে কম সুদের ঋণ। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দেয়, তার তুলনায় প্রকৃত খেলাপি বেশি বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মুুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের হিসাবে খেলাপি ঋণ হবে ৩ লাখ কোটি টাকারও বেশি। আইএমএফ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি দেখানোর পক্ষে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিয়েছিল, তা নিরীক্ষিত ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ খেলাপি করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অনেক ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে গেছে। বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিকেই উদ্বেগজনক মনে করছেন সবাই। তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। কিছু বেসরকারি ব্যাংকের এক-দু’জন পরিচালক একাই ব্যাংক চালাচ্ছেন। এসব ব্যাংকে কোনো সুশাসন নেই। এর প্রভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, আরও বাড়বে। কোনো খেলাপি ঋণ গোপন করলে তা আরও বড় সংকট হয়ে দেখা দেবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তদারকি ও পরিদর্শন ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই পারে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সুশাসন ফেরাতে। এসব ঋণ প্রায় এক যুগ আগে দেওয়া। এসব ঋণ মাঝে মাঝে পুনঃতফসিল হয়। আবার কিছুদিন পর খেলাপি হয়ে পড়ে। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। নতুন বিতরণ করা কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। সরকারি ব্যাংক ও খেলাপি ঋণ একসময় একসূত্রে গাঁথা ছিল। এই প্রবণতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকে। বিশেষ করে যেসব বেসরকারি ব্যাংক এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে, সেই ব্যাংকগুলোয় বেশি অনিয়ম হচ্ছে। এসব ঋণ ধীরে ধীরে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে ঋণ আদায় না হওয়ায় বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে ও বেশি সুদে আমানত নিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নতুন ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে চলতি বছরের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক দশকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ আসলে ছিল না। বরং সরকার বিভিন্ন সময় ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের নীতি নিলেও তা কার্যকর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তা বাস্তবায়ন করেছে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকারদের দৃঢ়তা ও সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। ঋণখেলাপিদের ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর হাতে পুরো ক্ষমতা থাকা উচিত। কোনো গ্রাহকের মুখ দেখে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তাহলে প্রভাবশালীরা ছাড় পাবে না। পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে বিচারক, বেঞ্চ বাড়ানোসহ আইনি কাঠামো জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। তাহলে খেলাপিদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয় কাজ করবে। খেলাপি ঋণ কমাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে ব্যাংক খাতের জন্য কমিশন গঠনের কথা বলছেন, এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। সামনে ব্যাংকের জন্য যে পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন হবে এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধসংক্রান্ত আইনকানুন পরিপালনের শর্ত আসছে, তাতে কতগুলো ব্যাংক টিকতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে। ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কাজে মালিকদের হস্তক্ষেপ রয়েছে, এমন অভিযোগ অনেক দিনের। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর মালিকানা কাঠামো ভারতের মতো নয়। অনেক দেশে বাংলাদেশের মতো ব্যবসায়ী ও করপোরেট গ্রুপ ব্যাংকের মালিক হতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন কাঠামো ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে চলে আসছে। এটা দিনে দিনেই ঠিক হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ -এই দুই দেশ বাদে সবাই খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে কমাচ্ছে। বাকি দেশগুলো মূলত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, নজরদারি বৃদ্ধি, শাস্তি প্রদান, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না দেওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায় এবং দুর্বল ব্যাংক বন্ধ বা অন্যের সঙ্গে একীভূত করেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনেছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশের আইনে নেই। নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করলে সবাই ঋণখেলাপি। তবে কী কারণে ঋণ পরিশোধ করা যায়নি, তা নির্ধারণ করেন আদালত। উন্নত দেশগুলোতে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত আইনকানুন অত্যন্ত কঠোর। খেলাপি হলে আদালতে যেতে হয়, সেখানে মামলা ঝুলেও থাকে না। আদালতের রায়ে একবার খেলাপি সাব্যস্ত হলে স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ে। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আসে। সিঙ্গাপুরে ঋণ খেলাপের শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর জেল ও ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা। অস্ট্রেলিয়ায় ঋণ খেলাপির ক্ষেত্রে করপোরেশন অ্যাক্ট ২০০১ ও ব্যাংক্রাপ্টসি অ্যাক্ট ১৯৬৬ নামে দুটি আইন কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের নাম ব্যাংক্রাপ্টসি অ্যাবিউজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কনজ্যুমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট এবং দ্য ফ্রড এনফোর্সমেন্ট অ্যাক্ট। ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিষয়টি আসলে ভারত থেকে আমদানি করা। পাকিস্তান মূলত ভারতকে অনুসরণ করেই ইচ্ছাকৃত খেলাপি বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশ সেই সংজ্ঞাই হুবহু অনুকরণ করেছে। যুক্তরাজ্য ও কানাডায়ও একই ধরনের আইন রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঋণ খেলাপির ব্যাংক হিসাবসহ সব সম্পদ জব্দ করা হয়। জব্দ করার পর ঋণ পরিশোধ করতে না পারার যথাযথ কারণ দেখাতে পারলে তবেই আদালতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে ঋণখেলাপিদের প্রতি সবচেয়ে কঠোর চীন ও ভিয়েতনাম। এই দুই দেশ ঋণ খেলাপ ও অর্থ আত্মসাতের জন্য মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়েছে। চীনের ঋণখেলাপিরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না, বিমান বা রেলের টিকিটও কিনতে পারেন না। এশিয়ার, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোই খেলাপি ঋণ কমাতে বেশি সফল। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বিষয়ে কোনো সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি নেই। বেসরকারি খাতে কিছু ঋণ আদায়কারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা খুব একটা কার্যকর নয়। আর খেলাপি ঋণ কেনাবেচার ব্যবস্থা চালু থাকলেও তার নেতিবাচক প্রভাবই বেশি। কেননা, মূলত এখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক অন্য বেসরকারি ব্যাংকের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ কিনে নিয়েছে। আর এ সুবিধা পেয়েছে প্রভাবশালীরাই। তারা এর ফলে নতুন করে ঋণ নিয়ে আবারও খেলাপি হয়েছে। তবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনই যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আইন ও এর প্রয়োগ করতে হবে। আর থাকতে হবে রাজনৈতিক ইচ্ছা। দেশে ব্যাংক খাত ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, অর্থ ও ঋণ নিয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে। এরপর দাতাদের সহায়তায় আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ, সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। অর্থঋণ আদালত আইন পাস করা হয় ১৯৯০ সালে, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সালে আর ১৯৯৭ সালে পাস হয় দেউলিয়া আইন। এত কিছুর পরও খেলাপি ঋণ তেমন কমেনি; বরং উল্টো ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে ২০০৯ সালে যে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা, তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। আর আইএমএফের সংজ্ঞা মানলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি, প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। প্রভাবশালীদের বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে মূলত ২০০৯ সালের পর থেকে। তাদের চাপে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়, ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নামে দেওয়া হয় খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা, ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়, আর সর্বশেষ ২০১৯ সালে ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। এসব ছাড়ের কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে, ঘটেছেও অনেকগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারি।

সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না, কোনো সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না, নিষেধাজ্ঞা থাকবে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স এবং কোম্পানি নিবন্ধনে। যারা খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি এই দেশে হচ্ছে না, যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সেই ব্যাংকও কোনো শাস্তির আওতায় আসছে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের জন্যই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না। যারা খেলাপি হচ্ছে, তাদের কোনো শাস্তি এই দেশে হচ্ছে না। যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি, সেই ব্যাংকও কোনো শাস্তির আওতায় আসছে না। আবার ঋণ পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল, স্থগিতাদেশের নামে অনেক ঋণের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হচ্ছে। ফলে দেশে খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা অজানা রয়ে যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ কমাতে হলে আগে প্রকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে হবে। এরপর আইনি ব্যবস্থা জোরদার করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন পরপর খেলাপিদের ছাড় দিতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা বন্ধ করে দিতে হবে। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) আয়োজিত সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশের ব্যাংক খাতের অস্বস্তির বিষয় খেলাপি ঋণ। এটা কমাতে ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় যাঁরা আছেন, তাঁদের বিশেষ করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব নিতে হবে। শীর্ষ কর্তারা শক্তভাবে পদক্ষেপ নিলে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের সমস্যা কমে আসবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ‘দূরদর্শী নীতিমালা’ প্রণয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এটা করতে হলে আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হবে এবং কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এর আগে এবিবি এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কাজের জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি দরকার। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা কঠোর করতে হবে এবং এ খাতে লোকবল বাড়াতে হবে। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানামুখী পদক্ষেপ অব্যাহত আছে। ব্যাংকার, পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক তিন পক্ষকেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। তাদের জন্য খারাপ ও প্রভাবশালী গ্রাহকেরা ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত, তা প্রকাশ করতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাংকার, পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক তিন পক্ষকেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠছে, কে করবে এ পরিকল্পনা, কে আনবে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন?

গত জানুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। এই ঋণ দিতে আইএমএফ শর্ত দিয়েছিল, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার কমাতে হবে, যাতে দেশের ব্যাংক খাত বড় ধরনের কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে। সংস্কারের এই উদ্যোগ নেওয়ার মধ্যেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যাতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে না যায়, সে জন্য গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে বিশেষ ছাড় দেয়। শিথিল করে ঋণ খেলাপি হওয়ার নীতিমালা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ, মালদ্বীপের ৬ শতাংশের কম, পাকিস্তান ও ভুটানের ৮ শতাংশের কম।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর খেলাপি ঋণের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অবশ্য উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের বিষয়টি বহু বছর ধরে আলোচনায় আছে। নির্বাচনের আগে সব দলই খেলাপি ঋণ কমানো ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু নির্বাচনের পর হয় তার উল্টো। গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, তার অন্যতম শর্ত ছিল ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার কমাতে হবে। সম্প্রতি আইএমএফের প্রতিনিধি দল এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে ‘হবে, হচ্ছে’ বলে কিছু অনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। দু-একটি ছাড়া বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকেরাই নিয়মবহির্ভূতভাবে কোটি কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দৌরাত্ম্য কমাতে সরকার আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শামিল। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হলেও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটেনি। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজ করে। বহির্বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন করণীয় না থাকলেও তারা অন্তত আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিতে পারে। ঋণগ্রহীতারা যদি নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবেন কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি হয়েও পার পেয়ে যান, সরকারের কোনো আইন ও পদক্ষেপই কাজে আসবে না। জনতা ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের দুই এমডির প্রস্থানের পর দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে কিন্তু কোনো এমডি তো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ঋণ পাসে অপারগতা প্রকাশ করে পদত্যাগ করেননি। ভালো ব্যাংকার হলে সৎ সাহস দেখাতে পারতেন। শুধু তা-ই নয়, অনেক ব্যাংকারের বিরুদ্ধে কম মূল্যের জামানত বেশি মূল্যে দেখানো, বৈশ্বিক বিপদ-আপদে ব্যবসায়ীকে প্রয়োজনীয় পরিচালনা মূলধন না দিয়ে ব্যবসাকে কঠিন করে তোলা, অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দাবি করা ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। তবে এটা ঠিক, রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর্থিক খাত হলো দেশের প্রাণ, এটাকে নষ্ট করা মানে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে আনা। জনগণের বাজেটের টাকা দিয়ে ব্যাংকের মূলধন জোগান দেওয়া হচ্ছে কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের চাপে কখনো কখনো এ খাতে কিছু সংস্কার দেখা গেলেও স্থায়ী কোনো সংস্কার এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তবু আশায় আছি, সরকার কোনো না কোনো সময় ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে সংসদে আইন পাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত, তা প্রকাশ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সততা, বিচক্ষণতা ও সাহসের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে ব্যাংক খাত তদারকি করতে হবে। দোষীদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলেই খেলাপি ঋণ কমবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত